ব্যাপারটা অলৌকিকই বটে। কারণ, তদবির ও পূর্ব-অভিজ্ঞতা ছাড়া চাকরি যখন সোনার
হরিণ এবং দুই দিন আগেও যার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে দুটো আশার কথা বলার জো ছিল
না, সেই জামিল কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে একটি চাকরির গর্বিত মালিক।
যোগদানপত্র হাতে পেয়ে জামিল এতটাই অবাক হলো যে এটা সত্যিই বিশ্বাসযোগ্য কি
না, দেখার জন্য সঙ্গে সঙ্গেই অফিসে ছুটে গিয়েছিল সে।
অসম্ভব সুন্দর একটা অফিস। বসও চমৎকার একজন মানুষ। শুরু থেকেই আন্তরিক একটা পরিবেশ পেয়ে যাওয়ায় জামিল নিজেকে ভাগ্যবান ভাবতে শুরু করল। সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল, কিন্তু বিপত্তিটা বাধল তখনই যখন সকালে তাকে বসের স্পেশাল চেম্বারে ডাকা হলো। রুমের পশ্চিম পাশে তাকিয়ে জামিলের আর চোখ ফেরানোর কোনো উপায় ছিল না। পৃথিবীর সব রূপ শরীরে ধারণ করা এক তরুণী অদ্ভুত মাদকতাময় ভঙ্গি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে। না, কোনো রক্তমাংসের মানুষ নয়, দেয়ালে একটি সাদাকালো ছবি হয়ে ঝুলে আছে সে। শুরু থেকেই ছবিটা দুর্নিবার আকর্ষণ তৈরি করল জামিলের মনে। কিন্তু বসের রুমে প্রতিদিন গেলেও তার পরিচয় আর জানা হয় না জামিলের। অত্যন্ত লাজুক স্বভাবের হওয়ায় বস তো বটেই অন্যান্য সহকর্মীর কাছেও এটা জিজ্ঞেস করতে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগে সে।
শুরুতে আকর্ষণটা সহনীয় পর্যায়েই ছিল। একসময় এটা এমন অবস্থায় দাঁড়াল যে জামিল কোনো কারণ ছাড়াই বসের রুমে যাওয়ার ছুতো খুঁজতে লাগল। জামিল দেখতে মোটামুটি সুদর্শন ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হওয়ায় অফিসে অবিবাহিত ও বিবাহিত দুই ধরনের মেয়ে মহলেই তার যথেষ্ট সুখ্যাতি। জামিলের আশপাশে সুন্দরীরও কোনো অভাব নেই। কিন্তু তাদের পাত্তা না দিয়ে জামিল কেন ছবির একটা মেয়ের প্রতি এতটা আকুল হয়ে উঠল, এটা তার বোধগম্য হয় না। ছবির মেয়েটি ক্রমশ দেয়াল থেকে জামিলের প্রতিটি কর্মকাণ্ডের একটা অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠল। তার ঘুমাতে যাওয়া, ঘুম থেকে ওঠা, খাওয়া, অফিসে যাওয়া—সবকিছুর মধ্যে সেটার একটা অপ্রতিরোধ্য চৌম্বকীয় আবেশ তৈরি হতে থাকল। রবিঠাকুরের উপন্যাস শেষের কবিতার নায়িকার নামে জামিল মেয়েটার নাম দিল ‘লাবণ্য’। তার সবকিছুই অতঃপর একসময় ‘লাবণ্যে আবর্তিত’ হতে থাকে। অফিস ছুটির সময় তীব্র মনখারাপ নিয়ে বাড়ি ফেরে জামিল। একটা অদ্ভুত মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা শুরু হয়েছে, এটা সে বুঝতে পারছে; কিন্তু এ থেকে উত্তরণের কোনো পথ জামিলের জানা নেই।
পৃথিবীর চিরাচরিত ধারা—কোনো কিছুই সব সময় এক নিয়মে চলে না। অফিসের একজন সহকর্মীর সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে জামিল একদিন জানতে পারে, ছবিটি তার বসের অকালপ্রয়াত স্ত্রীর। বিষয়টি সে অতি কষ্টে মেনে নিলেও ছবির ‘লাবণ্য’ তার মন থেকে একেবারে মুছে গেল না।
বছর পাঁচেক পর এক ফাগুনসন্ধ্যা। জামিল তত দিনে একটা বহুজাতিক কোম্পানিতে যোগ দিয়েছে। হঠাৎ করেই সাবেক বস তাকে ফোন দিলেন, ‘জামিল, তুমি এখনই চলে এসো আমার অফিসে। একটুও দেরি করা যাবে না কিন্তু।’
জামিল অপ্রত্যাশিত এই আমন্ত্রণে হতবাক হয়েই অফিসে ছুটল। বসের রুমে ঢুকেই জামিল আপাদমস্তক ঝাঁকুনি খেল। এ কী দেখছে সে? এ তো সেই ছবির ‘লাবণ্য’।
তাহলে কি সে যা জেনেছে, সেটা ভুল ছিল? কিন্তু সেটাই বা কীভাবে সম্ভব! কারণ, এত দিনে তাঁর স্ত্রীর বয়স কি তবে একটুও বাড়েনি?
জামিলের সাবেক বস জামিলকে মেয়েটির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন, ‘জামিল, এ হচ্ছে আমার একমাত্র মেয়ে সোহানা। লন্ডন থেকে এমবিএ শেষ করে আমার এখানেই ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে জয়েন করেছে।’
সোহানা এগিয়ে এসে জামিলের সঙ্গে হাত মেলাল আর বহুদিনের চেনা সেই বাঁকা হাসি দিয়ে জামিলকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কি আমাদের কোম্পানিতে আবার জয়েন করবেন? আপনার মতো বিশ্বস্ত একজনকে আমাদের অনেক প্রয়োজন।’
জামিল বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রইল।
রিনি জুলিয়েট রোজারিও
গুলশান, ঢাকা।
অসম্ভব সুন্দর একটা অফিস। বসও চমৎকার একজন মানুষ। শুরু থেকেই আন্তরিক একটা পরিবেশ পেয়ে যাওয়ায় জামিল নিজেকে ভাগ্যবান ভাবতে শুরু করল। সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল, কিন্তু বিপত্তিটা বাধল তখনই যখন সকালে তাকে বসের স্পেশাল চেম্বারে ডাকা হলো। রুমের পশ্চিম পাশে তাকিয়ে জামিলের আর চোখ ফেরানোর কোনো উপায় ছিল না। পৃথিবীর সব রূপ শরীরে ধারণ করা এক তরুণী অদ্ভুত মাদকতাময় ভঙ্গি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে। না, কোনো রক্তমাংসের মানুষ নয়, দেয়ালে একটি সাদাকালো ছবি হয়ে ঝুলে আছে সে। শুরু থেকেই ছবিটা দুর্নিবার আকর্ষণ তৈরি করল জামিলের মনে। কিন্তু বসের রুমে প্রতিদিন গেলেও তার পরিচয় আর জানা হয় না জামিলের। অত্যন্ত লাজুক স্বভাবের হওয়ায় বস তো বটেই অন্যান্য সহকর্মীর কাছেও এটা জিজ্ঞেস করতে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগে সে।
শুরুতে আকর্ষণটা সহনীয় পর্যায়েই ছিল। একসময় এটা এমন অবস্থায় দাঁড়াল যে জামিল কোনো কারণ ছাড়াই বসের রুমে যাওয়ার ছুতো খুঁজতে লাগল। জামিল দেখতে মোটামুটি সুদর্শন ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হওয়ায় অফিসে অবিবাহিত ও বিবাহিত দুই ধরনের মেয়ে মহলেই তার যথেষ্ট সুখ্যাতি। জামিলের আশপাশে সুন্দরীরও কোনো অভাব নেই। কিন্তু তাদের পাত্তা না দিয়ে জামিল কেন ছবির একটা মেয়ের প্রতি এতটা আকুল হয়ে উঠল, এটা তার বোধগম্য হয় না। ছবির মেয়েটি ক্রমশ দেয়াল থেকে জামিলের প্রতিটি কর্মকাণ্ডের একটা অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠল। তার ঘুমাতে যাওয়া, ঘুম থেকে ওঠা, খাওয়া, অফিসে যাওয়া—সবকিছুর মধ্যে সেটার একটা অপ্রতিরোধ্য চৌম্বকীয় আবেশ তৈরি হতে থাকল। রবিঠাকুরের উপন্যাস শেষের কবিতার নায়িকার নামে জামিল মেয়েটার নাম দিল ‘লাবণ্য’। তার সবকিছুই অতঃপর একসময় ‘লাবণ্যে আবর্তিত’ হতে থাকে। অফিস ছুটির সময় তীব্র মনখারাপ নিয়ে বাড়ি ফেরে জামিল। একটা অদ্ভুত মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা শুরু হয়েছে, এটা সে বুঝতে পারছে; কিন্তু এ থেকে উত্তরণের কোনো পথ জামিলের জানা নেই।
পৃথিবীর চিরাচরিত ধারা—কোনো কিছুই সব সময় এক নিয়মে চলে না। অফিসের একজন সহকর্মীর সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে জামিল একদিন জানতে পারে, ছবিটি তার বসের অকালপ্রয়াত স্ত্রীর। বিষয়টি সে অতি কষ্টে মেনে নিলেও ছবির ‘লাবণ্য’ তার মন থেকে একেবারে মুছে গেল না।
বছর পাঁচেক পর এক ফাগুনসন্ধ্যা। জামিল তত দিনে একটা বহুজাতিক কোম্পানিতে যোগ দিয়েছে। হঠাৎ করেই সাবেক বস তাকে ফোন দিলেন, ‘জামিল, তুমি এখনই চলে এসো আমার অফিসে। একটুও দেরি করা যাবে না কিন্তু।’
জামিল অপ্রত্যাশিত এই আমন্ত্রণে হতবাক হয়েই অফিসে ছুটল। বসের রুমে ঢুকেই জামিল আপাদমস্তক ঝাঁকুনি খেল। এ কী দেখছে সে? এ তো সেই ছবির ‘লাবণ্য’।
তাহলে কি সে যা জেনেছে, সেটা ভুল ছিল? কিন্তু সেটাই বা কীভাবে সম্ভব! কারণ, এত দিনে তাঁর স্ত্রীর বয়স কি তবে একটুও বাড়েনি?
জামিলের সাবেক বস জামিলকে মেয়েটির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন, ‘জামিল, এ হচ্ছে আমার একমাত্র মেয়ে সোহানা। লন্ডন থেকে এমবিএ শেষ করে আমার এখানেই ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে জয়েন করেছে।’
সোহানা এগিয়ে এসে জামিলের সঙ্গে হাত মেলাল আর বহুদিনের চেনা সেই বাঁকা হাসি দিয়ে জামিলকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কি আমাদের কোম্পানিতে আবার জয়েন করবেন? আপনার মতো বিশ্বস্ত একজনকে আমাদের অনেক প্রয়োজন।’
জামিল বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রইল।
রিনি জুলিয়েট রোজারিও
গুলশান, ঢাকা।