ইসলাম

 

হজরত আলী (রা.)-এর পরিবারে যত মর্মস্পর্শী ঘটনা

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

হজরত আলী (রা.)-এর পরিবারে যত মর্মস্পর্শী ঘটনা

একনজরে হজরত আলী (রা)-এর পরিবার

ইসলামের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ নাম হজরত আলী বিন আবু তালিব (রা.)। মাত্র ৯ বছর বয়সে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং মহানবী (সা.)-এর জামানায় তিনিই প্রথম পুরুষ যিনি কলেমা উচ্চারণ করে মুসলমান হিসেবে প্রকাশ্যে ঘোষণা দেওয়ার ঝুঁকি গ্রহণ করেন।

পবিত্র কোরআন নাজিলের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সঙ্গী ছিলেন হজরত আলী (রা.)। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ সৈয়দ আলী আজগর রাজী তার বিখ্যাত বই ‘এ রিস্টেটমেন্ট অব দ্য হিস্ট্রি অব ইসলাম অ্যান্ড মুসলিম’ গ্রন্থের ৫২ নং পৃষ্ঠায় লিখেছেন, হজরত আলী (রা.) এবং পবিত্র কোরআন হজরত মুহাম্মদ (সা.) ও খাদিজাতুল কুবরা (রা.)-এর ঘরে যমজ সন্তানের মতো বেড়ে ওঠে। তাঁর পিতা আবু তালিব সম্পর্কে মহানবী (সা.)-এর চাচা ছিলেন। অন্যদিকে মহানবী (সা.)-এর প্রিয় কন্যা ফাতেমা (রা.)-এর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে তিনি মহানবী (সা.)-এর জামাতায় পরিণত হন। হজরত আলী (রা.) ও মা ফাতেমা (রা.)-এর সংসারে তিন পুত্র ও দুই কন্যার জন্ম হয়। যাদের মধ্যে ইমাম হাসান (রা.) এবং ইমাম হোসেন (রা.) অন্যতম। ইমাম হোসেন (রা.)-এর শিশুপুত্র অর্থাৎ হজরত আলী (রা.)-এর নাতি আলী আল আজগর ইসলামের ইতিহাসে এক করুণ ঘটনার চরিত্র। ক্ষমতা ও ঐশ্বর্য লাভের সব সুযোগ থাকলে ইসলামের স্বার্থে এবং মহানবী (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসার টানে সব কিছু ত্যাগ করেন হজরত আলী (রা.)। তবে তার পরিবারে একের পর পর এক ঘটতে থাকে মর্মস্পর্শী ঘটনা, যার শেষ অধ্যায় রচিত হয় মহররম মাসে কারবালা প্রান্তরে।

 

বিষ মাখানো তরবারির আঘাতে হজরত আলী (রা.)-এর মৃত্যু

 

হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি আস্থা এবং মহান আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে মহানবী (সা.)-এর নবুয়ত প্রাপ্তির পর পরই পুরুষদের মধ্যে প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন হজরত আলী (রা.)। কাবা চত্বরে মহানবী (সা.)-এর চাচা আবু তালিব ও চাচি ফাতেমা বিনতে আসাদের ঘরে হজরত আলী (রা.) ৬০১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র ৯ বছর বয়সে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং মহানবী (সা.) জীবদ্দশায় সর্বদা তার সঙ্গী, বন্ধু, দেহরক্ষী, পরামর্শদাতা, সেনাপতিসহ নানা ভূমিকায় অনন্য ভূমিকা রাখেন। আত্মীয়তার দিক থেকে হজরত আলী (রা.) ছিলেন মহানবী (সা.)-এর চাচাত ভাই। মহানবী (সা.)-এর প্রাণপ্রিয় কন্যা এবং ইসলামের ইতিহাসে অনুকরণীয় নারী মা ফাতেমা (রা.) এর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার কারণে তিনি মহানবী (সা.)-এর জামাতায় পরিণত হন। মহানবী (সা.)-এর সঙ্গে তাকে ইসলামের জন্য জীবনের সব কিছু ব্যয় এবং জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে ইমান ও আমলের এক অনন্য নজির স্থাপন করেন হজরত আলী (রা.)। তাই তিনি ছিলেন মহানবী (সা.)-এর সাহাবি ও প্রিয়জনদের মধ্যে সর্বাধিক খেতাবপ্রাপ্ত।

মহানবী (সা.) ৬৩২ সালে এ জগৎ সংসার থেকে বিদায় নেন। তার উত্তরসূরি হিসেবে হজরত আলী (রা.)-এর সব ধরনের প্রতিভা, প্রজ্ঞা, শারীরিক ও মানসিক শক্তি, সামরিক জ্ঞান, প্রশাসনিক দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও তার বদলে ইসলামের প্রথম খলিফা নির্বাচিত হন হজরত আবু বকর (রা.)। পরবর্তীতে দ্বিতীয় ও তৃতীয় খলিফা নির্বাচিত হন যথাক্রমে হজরত ওমর (রা.) ও হজরত ওসমান (রা.)। হজরত আলী (রা.) এসব সিদ্ধান্ত শ্রদ্ধাভরে গ্রহণ করেন। তবে দুঃখজনকভাবে অপমৃত্যুর শিকার হন হজরত ওমর (রা.) এবং হজরত ওসমান (রা.)। এসব অপমৃত্যুসহ নানা কারণে মুসলমান, আরব বিশ্ব ও তৎকালীন ক্ষমতার বলয় বিভিন্ন গোত্র, দল ও উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ইসলামের তৃতীয় খলিফা হজরত ওসমান (রা.)-কে ৮২ বছর বয়সে ১৭ জুন ৬৫৬ সাল শুক্রবার বিকালে আসর নামাজের পর পবিত্র কোরআন পাঠরত অবস্থায় একদল বিপথগামী মিসরীয় আরব নির্মমভাবে হত্যা করে। এরপর মদিনার মসজিদে নববীতে অনুষ্ঠিত মুসলমানদের এক সমাবেশে হজরত আলী (রা.)-কে চতুর্থ খলিফা ও মুসলিম বিশ্বের নেতা নির্বাচন করা হয়। কিন্তু বিপথগামী আরবরা তা মানতে না পেরে হজরত আলী (রা.)-কে হত্যার পরিকল্পনা করে। এর মধ্যে ক্ষমতা গ্রহণের ১ বছরের মাথায় সিরিয়া সীমান্তে অবস্থিত ইউফ্রেতিস নদীর তীরে হজরত আলী (রা.) এবং তার বিরোধিতাকারী মুয়াবিয়া-১ এর বাহিনীর মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে উভয় পক্ষের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পর সিদ্ধান্ত হয় যে, আলোচনা ও সালিশের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করা হবে। ওই যুদ্ধে অংশ নেওয়া একদল আরব এমন সিদ্ধান্ত মানতে না পেরে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে পরবর্তীতে তাদের ‘ত্যাগকারী’ বা খারাজি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

হজরত আলী (রা.)-এর রাজত্ব পালনকালে খারাজিরা কট্টর পন্থা অবলম্বন করে এবং তাদের মতের সঙ্গে অমত পোষণকারীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। এক পর্যায়ে তারা সীমা অতিক্রম করে ভিন্ন মতাবলম্বীদের নাজেহাল করতে থাকে এবং সন্ত্রাসের পথ বেছে নেয়। হজরত আলী (রা.) তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেন এবং ৬৫৮ সনের জুলাই মাসে সংঘটিত ‘নাহরাওয়ান’ যুদ্ধে তাদের নেতা ইবনে ওহাবসহ অসংখ্য খারাজিকে হত্যা করেন। তবে অবশিষ্ট খারাজি ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদের শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকেন এবং হজরত আলী (রা.)-সহ আরও দুজন আরব নেতাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। এ জন্য তিন খারাজিকে পৃথকভাবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাদেরই একজন আবদুর রহমান ইবনে মুলযান বর্তমানে ইরাকের কুফা নগরে হিজরি ৪০ সনের ১৯ রমজান (২৬ জানুয়ারি ৬৬১ সাল) বিষ মাখানো তরবারি দিয়ে হজরত আলীকে সকালে ফজর নামাজ আদায়রত অবস্থায় আঘাত করে। তীব্র যন্ত্রণা ভোগের পর মূলত বিষক্রিয়ায় দুদিন পর শাহাদাতবরণ করেন হজরত আলী (রা.)। একদল গবেষকের মতে, হজরত আলী (রা.) আশঙ্কা করেন যে, তার মৃত্যুর পর শত্রুরা তার মৃতদেহ ও কবরকে অপমান করতে পারে। তাই নিকটাত্মীয় ও আপনজনদের প্রতি তার নির্দেশ ছিল মৃত্যুর পর যেন গোপনে তার সৎকার হয়, যা অনুসরণ করা হয়। ফলে দীর্ঘদিন তার কবরের সঠিক অবস্থান অজানা ছিল, পরবর্তীতে ইরাকের নাজাফ শহরে তার কবর রয়েছে বলে দাবি করা হয়। বর্তমানে সেখানে তার মাজার আছে বলে বিশ্বাস অধিকাংশের, যা ঘিরে নির্মিত হয়েছে সোনালি গম্বুজ বিশিষ্ট হজরত আলী মসজিদ। অপরদিকে বর্তমান আফগানিস্তানের উত্তরে বালাখ রাজ্যের মাজার-ই শরিফ নামক স্থানে আকর্ষণীয় নীল মসজিদের পাশে হজরত আলী (রা.)-কে গোপনে দাফন করা হয়েছে দাবি করে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে আরও একটি মাজার।

 

পিতার অবধারিত শাস্তির সংবাদ

হজরত আলী (রহ.)-এর পিতা আবু তালিব সম্পর্কের দিক থেকে প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর চাচা ছিলেন। পিতা-মাতাকে হারিয়ে শিশু মুহাম্মদ (সা.) ঠাঁই নেন চাচা আবু তালিবের ঘরে। কুরাইশ নেতা এবং উচ্চবংশীয় হিসেবে আবু তালিব তার পূর্ব পুরুষের সনাতন ধর্ম ত্যাগ করতে অপারগ ছিলেন। তবে নিজ ভ্রাতুষ্পুত্র মুহাম্মদ (সা.)-এর নিরাপত্তা ও ভরণ পোষণের জন্য তিনি যথেষ্ট সচেষ্ট ছিলেন। মহানবী (সা.) আপ্রাণ চেষ্টা করেন চাচা আবু তালিবকে কলেমা পড়াতে এবং জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাতে। কিন্তু নিজ বংশ এবং পূর্ব পুরুষের অহমিকার বেড়াজাল ছিন্ন করে আবু তালিবের পক্ষে কলেমা উচ্চারণ করা সম্ভব হয়নি। ইতিহাসবিদ ফ্রিড ম্যাকাগ্রো ডোনার ১৯৮৭ সালে তার লেখা ‘দি ডেথ অব আবু তালিব’ গ্রন্থে লিখেছেন মৃত্যুশয্যায়ও প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) আপ্রাণ চেষ্টা করেন অন্তত একবারের জন্য তাকে কলেমা পড়াতে। তবে বিধর্মী কুরাইশ নেতারা বারবার তাকে বলতে থাকেন যে, আবদুল মুতালিবের পুত্র ও কুরাইশ নেতা হিসেবে কিছুতেই তিনি যেন পিতৃপুরুষ ও বংশের ধর্ম ত্যাগ না করেন। ফলে তার পক্ষে আর কলেমা উচ্চারণ করা সম্ভব হয়নি। সুতরাং পৃথিবীতে থাকা অবস্থায় হজরত আলী বুঝতে পারেন তার বাবা আবু তালিব পরকালে কঠিন বিপদে পড়বেন। ইমাম বোখারি (রা.)-এর সহিহ বোখারি শরিফের ৬৪নং অধ্যায়ের ৩৮৮৫নং হাদিসের বর্ণনায় আবু সাঈদ আল খুদরি (রা.)-কে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, একদা কেউ একজন হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সামনে তার চাচা আবু তালিবের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন, প্রতি উত্তরে মহানবী (সা.) বলেন যে, তিনি প্রত্যাশা করেন, শেষ বিচারের দিন চাচা আবু তালিবের জন্য তার সুপারিশ কবুল হলে হয়তো কম শাস্তি পাবেন। আর সেই শাস্তি হবে এমন যে, দোজখের আগুন তার পায়ের গিরা বা অ্যাংকেল পর্যন্ত উঠবে। আর তাতেই আবু তালিবের মগজ ফুটন্ত পানি বা ভাতের মতো টগবগ করে ফুটবে। সহিহ মুসলিম শরিফের প্রথম অধ্যায়ে ইমাম মুসলিম (র.) ইবনে আব্বাস (রা.)-কে উদ্ধৃত করে ৪১৩নং হাদিসে বর্ণনা করেন, জাহান্নামের আগুনে সবচেয়ে কম শাস্তি হবে আবু তালিবের। তাকে আগুনের দুটি জুতা পরানো হবে যার তাপে তার (আবু তালিবের) মাথার মগজ ফুটতে থাকবে। পিতার এমন শাস্তির বিষয়ে পৃথিবীতেই নিশ্চিত হয়েছিলেন পুত্র হজরত আলী (রা.)। যা একজন সন্তানের জন্য খুবই হৃদয়বিদারক।

 

বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয় ইমাম হাসান (রা.) কে

হজরত আলী (রা.) এবং মা ফাতেমা (রা.)-এর জ্যেষ্ঠ সন্তান ইমাম হাসান (রা.)। ৬২৪ সনে জন্মগ্রহণ করার পর মহানবী (সা.) তার নাম রাখেন ‘আল হাসান’ এবং ইসলামী নিয়মে আকিকা করেন। মহানবী (সা.)-এর বড় নাতি হিসেবে বাল্যকালে অনেক স্নেহপ্রাপ্ত হন ইমাম হাসান (রা.)। ৬৩২ সনে মহানবী (সা.)-এর জাগতিক মৃত্যুর পর উপযুক্ত বয়সে ইমাম হাসান (রা.) এক নম্র, ভদ্র, দয়ালু, বিচক্ষণ ও সাহসী পুরুষ হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। বিশেষত ইসলামের তৃতীয় খলিফা হজরত ওসমান বিন আফফান (রা.) নিজ বাসগৃহে বিপক্ষ শক্তির আকস্মিক আক্রমণের শিকার হলে ইমাম হাসান (রা.) তা প্রতিহত করতে সচেষ্ট হন। পরবর্তী বা চতুর্থ খলিফা হজরত আলী (রা.)-এর শাসনামলে তিনি সাহসিকতার সঙ্গে সাফিন, নাহরাওয়ান এবং জামালের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং বীরত্বের স্বাক্ষর রাখেন।

৬৬১ সনে বিদ্রোহী খারাজিদের চক্রান্তে বিষ মাখানো তরবারির আঘাতে শাহাদাতবরণ করেন ইসলামের চতুর্থ খলিফা হজরত আলী (রা.)। এ অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যুর পর জ্যেষ্ঠ সন্তান হিসেবে ইমাম হাসান (রা.) হজরত আবু বকর (রা)-এর অনুকরণে স্থানীয় কুফা মসজিদে এক আবেগময় ভাষণ প্রদান করেন এবং মহানবী (সা.)-এর উত্তরসূরিদের খলিফা হওয়ার যুক্তি উপস্থাপন করেন। এ সময় উপস্থিত সবার সিদ্ধান্তে ইসলামের ৫ম খলিফা নির্বাচিত হন ইমাম হাসান (রা.)। তবে তা মেনে নিতে পারেননি হজরত আলী (রা.- এর পারিবারিক শত্রু মুয়াবিয়া। পরবর্তীতে সুয়াইরিয়া চিঠির মাধ্যমে এবং সৈন্য সমাবেশ ঘটিয়ে ইমাম হাসানকে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার আহ্বান জানায়। প্রতিউত্তরে ইমাম হাসান (রা.) তার মেয়াদ শেষ হওয়ার পক্ষে যুক্তি দেন এবং মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার আহ্বান জানান। কিন্তু উভয়ের মধ্যে তিক্ততা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, ক্ষমতা গ্রহণের সাত মাসের মাথায় ইমাম হাসান (রা.) ক্ষমতা ছেড়ে দেন। এরপর তিনি মদিনা ফিরে যান এবং একান্ত সাদামাটা জীবনযাপন করেন। তবুও তার শত্রুরা পিছু ছাড়েনি। ৬৭০ সনে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে হত্যা করা হয় ইমাম হাসান (রা.) কে। এই বিষ প্রয়োগের নেপথ্যে তার স্ত্রী জাদা বিনতে আল আসাদ, অপর একজন স্ত্রী এবং একজন দাসীর নাম উঠে আসে। মৃত্যুর পর মহানবী (সা.)-এর রওজার পাশে কবর দেওয়া নিয়েও বিতর্ক হয়। পরবর্তীতে মসজিদে নববীর পাশে জান্নাতুল বাকি কবরস্থানে ইমাম হাসান (রা.) কে সমাহিত করা হয়।

 

কারবালায় ১০ মহররম ইমাম হোসেন (রা.)-এর মাথা বিচ্ছিন্ন করা হয়

হজরত আলী (রা.) এবং মা ফাতেমা (রা.)-এর দ্বিতীয় পুত্র ইমাম হোসেন (রা.)-এর জন্ম ৬২৬ সনের জানুয়ারি মাসের ১১ বা ১৩ তারিখে। জন্মের পর বড় ভাই ইমাম হাসান (রা.)-এর মতো তিনিও নানা হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর স্নেহধন্য হয়েছিলেন। পরবর্তী জীবনে পিতা হজরত আলী (রা.)-এর অপমৃত্যু, মা ফাতেমা (রা.)-এর করুণ মৃত্যু এবং বড় ভাই ইমাম হাসান (রা.) কে বিষ প্রয়োগে হত্যার প্রেক্ষিতে ইমাম হোসেন (রা.) সঙ্গত কারণেই নিজেকে গুটিয়ে নেন। তিনি কেবল নিজ গোত্র বনু হাশিমের প্রধান হিসেবে সাধারণ জীবনযাপন করতে থাকেন। এ সময় কুফাবাসীর মধ্যে যারা মুয়াবিয়ার প্রতি বিভিন্ন কারণে বিক্ষুব্ধ ছিল তারা ইমাম হোসেন (রা.) কে কুফায় আগমনের আমন্ত্রণ জানায় এবং মুসলিম বিশ্বের হাল ধরার প্রস্তাব দেন। কিন্তু ইমাম হোসেন (রা.) তার ভাইয়ের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি মোতাবেক মুয়াবিয়া জীবিত থাকা অবস্থায় কোনো প্রকার নেতৃত্ব গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান। ৬৮০ সনে মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর তারই বিতর্কিত সিদ্ধান্ত মোতাবেক তার পুত্র ইয়াজিদ ক্ষমতায় আরোহণ করেন।

এ অযৌক্তিক আয়োজন মেনে নিতে পারেননি ইমাম হোসেন (রা.)। কিন্তু ইয়াজিদ যে কোনো মূল্যে ইমাম হোসেন (রা.)-এর আনুগত্য আদায়ে অনড় ছিলেন। তিনি বিভিন্ন প্রলোভন ও কূটকৌশলের মাধ্যমে মদিনার শাসক এবং প্রভাবশালীদের সমর্থন নিয়ে ইমাম হাসান (রা.)-এর ওপর নানামুখী চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন। এমনকি এক পর্যায়ে ইমাম হোসেন (রা.)-এর জীবনের ওপর হুমকি দেওয়া হয়। ফলে তিনি কুফা থেকে আপনজনদের সবুজ সংকেত পেয়ে কুফার পথে যাত্রা করেন। পথিমধ্যে তিনি ইয়াজিদের বাহিনীর সম্মুখীন হন এবং ইয়াজিদ বাহিনী ইমাম হোসেন (রা.) এর কাফেলা ও পরিবারকে মক্কা বা কুফার বদলে অন্য কোথাও সরে যেতে নির্দেশ দেন। অন্যদিকে কূটকৌশল ও শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে ইয়াজিদ বাহিনী ইমাম হোসেন (রা.) এবং তার সঙ্গীদের ‘কারবালা’ নামক পানিবিহীন স্থানে বা মরুভূমিতে অবস্থান নিতে বাধ্য করেন। ৬৮০ সনে অর্থাৎ হিজরি ৬১ সনের মহররম মাসের ৮, ৯ ও ১০ তারিখ এ ৩ দিন পানিবিহীন থাকার পর শিশুপুত্র আজগরের জন্য পানি সংগ্রহ করতে তাঁবু এলাকা ও কাফেলা থেকে বের হন এবং ধু-ধু মরুভূমিতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। এ সুযোগের অপেক্ষায় ছিল ইয়াজিদ বাহিনী। এ বাহিনীর নিক্ষিপ্ত তীর প্রথমে ইমাম হোসেন (রা.)-এর মুখে বিদ্ধ হয়। ইয়াজিদের বিশেষ ভক্ত ও অনুগত মালিক ইবনে নুসাইয়ার এ সময় ইমাম হোসেন (রা.) মাথায় আঘাত করেন। এতে তার মাথা কেটে রক্ত ঝরতে থাকে। এ সময় দৃশ্যপটে আসেন ইয়াজিদের বিশেষ অনুগত সিমার। ইমাম হোসেন (রা.) আহত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়লে সিমারের নির্দেশে সিনান ইবনে আনাস নামের এক নিষ্ঠুর সৈন্য ছুরি চালিয়ে ইমাম হোসেন (রা.)-এর দেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। এ তিন দিন বিভিন্ন ধাপে যুদ্ধ, তাঁবুতে অগ্নিসংযোগসহ নানা অত্যাচারে একে একে প্রাণ হারান ইমাম হোসেন (রা.)-এর শিশুপুত্র আলী আসগর (আবদুল্লাহ), আলী আকবরসহ তাঁর পরিবারের সব সদস্য এবং সঙ্গী সাথীগণ।

স্বল্প সংখ্যক বেঁচে থাকা সদস্যকে পরে বন্দী করা হয়। অন্যদিকে ইমাম হোসেন (রা.)-এর বিচ্ছিন্ন মাথাকে অপদস্ত করার তথ্য পাওয়া যায় এবং অন্তত সাতটি স্থানে তার পবিত্র মাথা দাফনের খবর পাওয়া যায়।

 

গোপনে সমাহিত হন ফাতেমা (রা.)

হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রিয় কন্যা ফাতেমা বিনতে মুহাম্মদ (রা.)-এর জন্ম ৬০৫ সনে মতান্তরে ৬১৫ সনে। তবে অধিকাংশের ধারণা, মহানবী (সা.) নবুয়ত প্রাপ্তির পর মা খাদিজা (রা.)-এর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। মহানবী (সা.) অত্যন্ত স্নেহ করতেন তাঁর কন্যা ফাতেমা (রা)-কে। মুসলমান সমাজে তিনি মা ফাতেমা (রা.) নামে অধিক পরিচিত। মহানবী (সা.) তাঁর সংগ্রামী জীবনে সব প্রতিকূল পরিবেশে কাছে পেয়েছেন এই প্রিয় কন্যাকে। যিনি তাঁর শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, সান্ত্বনা ও উপদেশ দিয়ে মহানবী (সা.)-কে সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। মা ফাতেমা (রা.)-ই মহানবী (সা.)-এর একমাত্র সন্তান, যাঁর পুত্র সন্তান অর্থাৎ মহানবী (সা.)-এর নাতি ইমাম হাসান ও ইমাম হোসেন (রা.) প্রাপ্ত বয়স্ক হতে পেরেছেন। মক্কাবাসীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ মহানবী (সা.) ইসলামের বৃহত্তর স্বার্থে ও নিজ জীবন রক্ষার্থে ৬২২ সনে মক্কা ছেড়ে মদিনায় হিজরত করেন। এ সময় তাঁর কন্যা ফাতেমা (রা.)ও মদিনায় চলে আসেন। অপরদিকে মহানবী (সা.)-এর সার্বক্ষণিক সঙ্গী ও প্রিয় বন্ধু হজরত আলী (রা.)ও তার সঙ্গে মদিনায় হিজরত করেন। মদিনায় আগমনের পর মহানবী (সা.) প্রিয় কন্যার বিবাহ আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেন। সার্বিক বিবেচনায় তিনি পাত্র হিসেবে হজরত আলী (রা.)- কে উপযুক্ত মনে করেন এবং নিজে ধর্মীয় রীতিনীতিতে উভয়ের বিবাহের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেন।

মক্কার কুরাইশ বংশের সন্তান হিসেবে হজরত আলী (রা.)-এর আর্থিক উন্নতি ও গোত্রের নেতৃত্ব দেওয়ার ব্যাপক সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু ইসলামের স্বার্থ ও মহানবী (সা.)-এর প্রতি সম্মান ও ভালোবাসার টানে তিনি সব কিছু ত্যাগ করে মদিনায় চলে আসেন। এমনকি বিবাহ করার মতো কোনো অর্থ না থাকায় তিনি মহানবী (সা.)-এর পরামর্শে তাঁর একমাত্র সম্বল যুদ্ধে ব্যবহৃত একটি ঢাল বিক্রি করে দেন। অপরদিকে মহানবী (সা.)-এর কন্যা হিসেবে মা ফাতেমা (রা.) যে কোনো ধনবান ব্যক্তিকে বিবাহ করতে পারতেন। কিন্তু ইসলামের স্বার্থে এবং পিতার প্রতি সম্মান জানিয়ে তিনি হজরত আলী (রা.)-কে বিবাহ করেন। চরম দরিদ্রতার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয় তাদের বিবাহিত জীবন। প্রথা মোতাবেক হজরত ফাতেমা (রা.)-এর কোনো দাস-দাসী রাখার সামর্থ্য ছিল না। নিজ হাতে তিনি সংসারের সব কাজ করতেন এবং মাঝে মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়তেন।

অন্যদিকে হজরত আলী (রা.) যথাসাধ্য ঘরের কাজে সাহায্য করার পর অন্যদের ভারী কাজ করতেন অর্থ উপার্জনের জন্য। এত দারিদ্র্যের মাঝেও তারা মহান আল্লাহর প্রতি সর্বদা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেন এবং মহানবী (সা.)-এর প্রতি অনুগত থাকতেন ও তাকে অনুপ্রেরণা জোগাতেন।

বহু ত্যাগ, তিতিক্ষা, সংগ্রাম ও যুদ্ধবিগ্রহের পর বিনা রক্তপাতে ৬২৯ সনে মক্কা বিজয় করেন মহানবী (সা.) ও তার অনুসারীরা। এই বিজয়ের নেপথ্যে যথেষ্ট অবদান রাখেন হজরত আলী (রা.) এবং মা ফাতেমা (রা.)। মক্কা বিজয়ের চার বছরের মাথায় মহানবী (সা.)-এর পার্থিব জীবনের অবসান ঘটে। তাঁর মৃত্যুর পর হজরত আলী (রা.) জানাজার জন্য সব প্রস্তুতি নিতে থাকেন। এ সময় শীর্ষ সাহাবি বা অনুসারীদের একাংশ হজরত আবু বকর (রা.)-কে ইসলামের খলিফা হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য নির্বাচন করেন। সব ধরনের যোগ্যতা এবং ব্যাপক সমর্থন থাকায় হজরত আলী (রা.)-কে অনেকেই মুহাম্মদ (সা.) পরবর্তী খলিফা হিসেবে ভাবতেন। ফলে তিনি স্বেচ্ছায় হজরত আবু বকর (রা.)-কে খলিফা হিসেবে মেনে নেন না বাধ্য হন, এ নিয়ে ইতিহাসবিদরা দুই ভাগে বিভক্ত। একই বিভক্তি রয়েছে এ সময় মা ফাতেমা (রা.)-এর প্রকৃত অবস্থান ও পরিণতি নিয়ে। একদল ইতিহাসবিদের মতে, হজরত আবু বকর (রা.)-এর পক্ষ অবলম্বনকারীরা হজরত আলী (রা.) এবং মা ফাতেমা (রা.)-এর আনুগত্য আদায়ের জন্য তাদের বাড়িতে হামলা চালান। এ সময় তাদের ওপর দৈহিক অত্যাচারের ঘটনাও উল্লিখিত কিছু কিছু বর্ণনায়। এই অত্যাচারের ফলে অসুস্থতা এবং পরবর্তীতে মা ফাতেমা (রা.)-এর মৃত্যু হয় বলে একদল গবেষকের মত। আবার আরেক দল মনে করে ৬৩২ সনে মৃত্যুর আগে মহানবী (সা.) বিদায় হজ পালন করেন। এই হজের পর পরই মহানবী (সা.) প্রিয় কন্যা মা ফাতেমা (রা.)-কে জানিয়ে দেন যে, তাঁর (মহানবীর) মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে। তিনি আরও জানান, তার বংশের মধ্যে মা ফাতেমা (রা.) হবেন পরবর্তী মৃত্যু পথযাত্রী। মহানবী (সা.)-এর পার্থিব মৃত্যুর পর মা ফাতেমা (রা.) মূলত একটি বিচ্ছিন্ন ঘরেই একাকী জীবন কাটাতেন এবং ইবাদত-বন্দেগির বাইরে প্রাণপ্রিয় পিতার শোকে অনবরত কাঁদতেন। এমনি এক বিষাদময় পরিস্থিতিতে মহানবী (সা.)-এর মৃত্যুর বছরই (৬৩২ সাল) পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন নারীকুলের শিরোমণি মা ফাতেমা (রা.)। তবে দুঃখের বিষয়, বিরোধী পক্ষ তার মৃতদেহ বা কবরকে অসম্মান করতে পারে আশঙ্কায় তিনি মৃত্যুর আগে আপনজনদের অনুরোধ করেন গোপনে তার দাপন সম্পন্ন করার জন্য। বাস্তবে তাই করা হয়। ফলে প্রকৃত পক্ষে মা ফাতেমা (রা.)-কে কোথায় কবর দেওয়া হয়, তার সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। শোকগ্রস্ত হজরত আলী (রা.) অতি গোপনেই কবরস্থ করেন মহানবী (সা.)-এর আদরের কন্যা ও তার প্রিয়তম স্ত্রী ফাতেমা (রা.)-কে।

কোন মন্তব্য নেই: