আশির দশকের শুরুর দিকে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর একটি হিসেবে স্ট্রিং তত্ত্ব নিজের জায়গা করে নেয়। ওই সময় প্রমাণিত হয়, স্ট্রিং তত্ত্ব গাণিতিকভাবে বিশুদ্ধ একটি তত্ত্ব এবং এ বিষয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে একটা জোয়ার আসে, যাকে পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে ‘প্রথম স্ট্রিং বিপ্লব’ বলা হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, শুরুর দিকে স্ট্রিং তত্ত্ব পদার্থবিদদের মনোযোগ ঠিক সেভাবে কাড়তে পারেনি। কিন্তু এই আশির দশক থেকেই মূলত স্ট্রিং তত্ত্ব তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার ক্ষেত্রে গবেষণার গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। আজকে এই স্ট্রিং বিপ্লবের সূত্রপাতের প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা করব।
আমি ইতিহাস বেশ পছন্দ করি, যদিও এই বিষয়টিতে আমার তেমন দক্ষতা নেই। সত্যি বলতে কি, পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাস আমাকে আনন্দ দেওয়ার পাশাপাশি বিষণ্নও করে। বিখ্যাত সব পদার্থবিদের নানা অর্জনের কথা পড়ে নিজেকে ক্ষুদ্র মনে হয়। আগের লেখাটিতে বলেছিলাম স্ট্রিং তত্ত্ব তিনটা বিষয়কে একীভূত করে । এক, পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন তত্ত্ব; দুই, প্রকৃতির মৌলিক বলসমূহ; তিন, প্রকৃতির মৌলিক কণাসমূহ। এর মধ্যে মৌলিক কণার একীভূতকরণ নিয়ে গত লেখায় কিছুটা ব্যাখ্যা দিয়েছি। আজকে স্ট্রিং–এর জন্মকথা দিয়ে শুরু করা যাক। তারপর আলোচনা করব তত্ত্ব একীভূতকরণ বিষয়টা নিয়ে।
এরপর ১৯৭০ সালের দিকে মার্কিন পদার্থবিজ্ঞানী লিওনার্ড সাসকিন্ড, ড্যানিশ পদার্থবিজ্ঞানী হলগার নিয়েলসন ও জাপানি পদার্থবিজ্ঞানী ইয়িচিরো নাম্বু দেখান যে ভেনেজিয়ানোর দেওয়া গাণিতিক বর্ণনাটা আরও যথার্থ হয় যদি কণার বদলে স্ট্রিং কল্পনা করা হয়। বিষয়টাকে একটু সহজভাবে বলার চেষ্টা করি। ধরা যাক, দুটি কণা একটি আরেকটিকে প্রচণ্ড গতিতে ধাক্কা দিল, তারপর দুদিকে চলে গেল। এই প্রক্রিয়াকে বলা যেতে পারে চার-কণার scattering। এখানে চার-কণা বলছি এই কারণে যে ধাক্কার পরে কণাগুলোর বৈশিষ্ট্যে কিছু পরিবর্তন আসতে পারে। এখন দুটি কণার বদলে রাবার ব্যান্ডের মতো দুটি সুতা বা তন্তু (স্ট্রিং) চিন্তা করলে তাদের একে অপরকে ধাক্কা দেওয়ার ব্যাপারটা অনেকটাই অন্য রকম হয়ে যায়। স্বাভাবিকভাবেই এই দুই প্রক্রিয়াকে গাণিতিকভাবে প্রকাশ করলে তা-ও ভিন্ন হবে।
মজার বিষয় হলো, সাসকিন্ডদের এই প্রস্তাব সে সময় কেউ অতটা গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি। এটাকে কেবলই একটা interesting পর্যবেক্ষণ হিসেবে দেখা হতো। আসলে পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণা ফ্যাশন দুনিয়ার মতোই ট্রেন্ডি। আর সেই সময় কণাতত্ত্বই ছিল আকর্ষণের কেন্দ্রে। কাজেই কয়েক বছরের মধ্যে এই ব্যাপারটা একরকম চাপা পড়ে গেল।
তবে ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (Caltech) তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী জন শোয়ার্জের বিশ্বাস ছিল, এই কণার পরিবর্তে স্ট্রিং নেওয়ার বিষয়টি বেশ সাহসী ধারণা এবং এটা একটি বড় তত্ত্বের ইঙ্গিতবাহী। তিনি ও তাঁর সহযোগী গবেষকেরা বিষয়টি নিয়ে ভাবতে থাকলেন এবং তাঁরাই একসময় এটাকে একটা তত্ত্ব হিসেবে দাঁড় করালেন। আরও পরিষ্কার করে বলা যায়, তাঁরা এই তত্ত্বকে মহাকর্ষীয় বলের একটা কোয়ান্টাম তত্ত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করলেন। পরে বিষয়টি নিয়ে আবার আসব।
দুঃখজনক বিষয় হলো, তারপরও স্ট্রিং তত্ত্ব পদার্থবিদদের মনোযোগ কাড়তে পারল না। মূল কারণ ছিল, তত্ত্বটিতে ‘Anomaly’ নামের একধরনের গাণিতিক সমস্যা ছিল। যা হোক, একপর্যায়ে ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী মাইকেল গ্রিন শোয়ার্জের সঙ্গে যোগ দিলেন। তাঁরা প্রায় ১০ বছর ধরে তত্ত্বের এই Anomalyগুলো দূর করার চেষ্টা করে ১৯৮৪ সালে এসে সফল হলেন। এই কাজ Green-Schwarz mechanism নামে পরিচিত। এর ফলে স্ট্রিং তত্ত্বের গবেষণার ধারা সম্পূর্ণরূপে বদলে গেল। আশির দশকে স্ট্রিং তত্ত্ব হয়ে দাঁড়াল পদার্থবিদ্যার সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয়গুলোর একটি। এই Green-Schwarz mechanism প্রথমবারের মতো স্ট্রিং তত্ত্বের গবেষণার ক্ষেত্রে একধরনের বিপ্লবের সূচনা করে, যা প্রথম স্ট্রিং বিপ্লব নামে পরিচিত।
যেহেতু মাইকেল গ্রিন এবং জন শোয়ার্জের প্রসঙ্গ এল, তাই এঁদের নিয়ে একটা গল্প বলার লোভ সামলাতে পারছি না। আমি যখন পিএইচডি করছিলাম, তখন স্ট্রিং তত্ত্ব নিয়ে বাজারে খুব বেশি পাঠ্যবই ছিল না। যে দু–একটা বই ছিল, তার ভেতর একটা ছিল মাইকেল গ্রিন, জন শোয়ার্জ ও এডওয়ার্ড উইটেনের লেখা। বইটার কভার পেজ সবুজ রঙের। বইটা নিয়ে একটা রসিকতা চালু আছে। বলা হয়, বইটার সবচেয়ে ভালো অংশগুলো এডওয়ার্ড উইটেনের লেখা। বাকি অংশ লেখা জন শোয়ার্জের। আর সবুজ (গ্রিন) কভার পেজটা মাইকেল গ্রিনের অবদান। পাঠকের জন্য জানাচ্ছি, এডওয়ার্ড উইটেন হচ্ছেন এই সময়ের সবচেয়ে বিখ্যাত ও অসাধারণ মেধাবী একজন পদার্থবিজ্ঞানী। উনিই Fields Medal পাওয়া একমাত্র পদার্থবিজ্ঞানী। Fields Medal হচ্ছে গণিতে অসাধারণ অবদানের জন্য দেওয়া সবচেয়ে বড় পুরস্কার। এটি নোবেল পুরস্কারের মতোই সম্মানজনক। নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে ‘দ্বিতীয় স্ট্রিং বিপ্লব’ এডওয়ার্ড উইটেনের হাত ধরেই আসে। এ বিষয়ে অন্য কোনো দিন বলব।
এখন আবার ফিরে আসি তত্ত্ব একীভূতকরণ প্রসঙ্গে। প্রায়শই তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের উন্নতি নির্ণয় করার জন্য তা ভিন্ন ভিন্ন তত্ত্বকে একীভূত করতে পারছে কি না, তা একটা বড় সূচক হিসেবে কাজ করে। একটা সহজ উদাহরণ দিয়ে শুরু করা যাক। বহু বছর ধরে বিদ্যুৎ ও চৌম্বকত্বকে সম্পর্কহীন ভিন্ন ভিন্ন বিষয় হিসেবে দেখা হতো। পরে ১৮৬৫ সালে জেমস ক্লার্ক মাক্সওয়েল নামের একজন স্কটিশ পদার্থবিদ চারটি অতি সাধারণ কিন্তু নান্দনিক সমীকরণ দিয়ে এই বিষয়ে আমাদের চিন্তাধারা সম্পূর্ণ বদলে দিলেন। তিনি এই দুটি আপাতভিন্ন বিষয়কে একটা সাধারণ গাণিতিক কাঠামোর ভেতর নিয়ে এলেন। তা ছাড়া এই সমীকরণগুলো তড়িৎচৌম্বকীয় তরঙ্গ সম্পর্কেও পরিষ্কার ধারণা দেয়। এখানে একটা বিষয় বলে নেওয়া ভালো, এই বিদ্যুৎ ও চৌম্বকত্বকে একীভূতকরণ তথা মাক্সওয়েলের সমীকরণগুলো কিন্তু কোনো ঐচ্ছিক ব্যাপার নয়। এটা ছাড়া বিদ্যুৎ ও চৌম্বকত্বের ধারণাটাই অসামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।
এর প্রায় চল্লিশ বছর পর পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে মানুষের চিন্তার ক্ষেত্রে আরেকটা যুগান্তকারী পরিবর্তন (change of paradigm) সূচিত হয়। এটাও আসে একধরনের একীভূতকরণের চেষ্টা থেকে। আইনস্টাইন নামের মাত্র ২৬ বছরের এক পেটেন্ট অফিসের কেরানি ‘স্থান’ ও ‘কাল’ মূলত একই—এটা বলে পদার্থবিদদের একেবারে চমকে দিলেন। এখানে লক্ষ করার বিষয় হলো, আইনস্টাইন বয়সে তরুণ ছিলেন তা ঠিক, কিন্তু তিনি ক্র্যাক পট তা ছিলেন না। তাঁর আন্ডার গ্র্যাজুয়েট পড়াশোনার বিষয়ই ছিল পদার্থবিজ্ঞান। এরও প্রায় ১০ বছর পরে ১৯১৬ সালে আইনস্টাইন আপেক্ষিকতাবাদের ধারণাকে একটি বিশেষ ক্ষেত্র থেকে সাধারণ তত্ত্বে (General theory of Relativity) পরিণত করেন। সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ নিঃসন্দেহে পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে আলোচিত তত্ত্ব। এর আবিষ্কারক হিসেবে আইনস্টাইন পেয়ে যান রকস্টারদের মতো খ্যাতি।
প্রকৃতির নিয়মগুলো বুঝতে উক্ত তত্ত্বগুলো আমাদের চিন্তার ক্ষেত্রে অসাধারণ পরিবর্তন আনে। এরই ধারাবাহিকতায় গত শতকের প্রথম দুই-তিন দশকে পদার্থবিজ্ঞানের জগতে আরেকটা খুব বড় ওলট–পালট হয় কোয়ান্টাম বলবিদ্যার হাত ধরে। কোয়ান্টাম বলবিদ্যা হলো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জগতের পদার্থবিদ্যা। কোয়ান্টাম বলবিদ্যাকে অনেক সময় তত্ত্ব না বলে বলা হয় ‘চিন্তাকাঠামো’। এটা মূলত কিছু নিয়মের অবতারণা করে, যে নিয়ম মেনে তত্ত্বগুলোকে ব্যবহার করা হয়। উদ্দেশ্য হলো এর থেকে physical prediction করা। মজার ব্যাপার হলো, কোয়ান্টাম বলবিদ্যা এবং আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ (যাকে মহাকর্ষীয় বলের তত্ত্ব বলা হয়) এই দুটি অতি বিখ্যাত তত্ত্ব একটি আরেকটিকে একদমই পছন্দ করে না। আর সেই জন্যই প্রয়োজন পড়ে স্ট্রিং তত্ত্বের। এখানে লক্ষণীয়, এই সমস্যাটা কিন্তু তড়িৎ চুম্বকীয় বলের কোয়ান্টাম তত্ত্বের ক্ষেত্রে হয় না, বা বলা ভালো সমস্যাটা ততটা প্রকট না। সে ক্ষেত্রে আমরা Photon-কণা পাই, কিন্তু মহাকর্ষ বলের জন্য Graviton-কণা পাওয়া যায় না।
এই অতি জটিল গাণিতিক সমস্যাটা সমাধানে আমাদের দরকার হয় স্ট্রিং তত্ত্বের। স্ট্রিং তত্ত্ব সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ (মহাকর্ষীয় বলের তত্ত্ব) এবং কোয়ান্টাম বলবিদ্যা এই দুটি পরস্পরবিরোধী বিষয়কে একীভূত করে। একটু ব্যাখ্যা করা যাক, সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ একটা ক্ল্যাসিক্যাল তত্ত্ব এবং এই তত্ত্বের কোয়ান্টাম রূপ দেওয়া অসম্ভব কঠিন একটা ব্যাপার। বলা ভালো, এরা একে ওপরের জন্য ঠিক তৈরি না। কিন্তু সমস্যা হলো মহাকর্ষীয় বলের কোয়ান্টাম তত্ত্ব আমাদের দরকার, এটা কোনো ঐচ্ছিক বিষয় নয়। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একদম শুরুর অবস্থা অথবা কৃষ্ণ বিবরের (Black Hole) ভেতরে কী হচ্ছে, তা জানার জন্য অন্য কোনো উপায় নেই। ধরা যাক কেউ একজন বোকার মতো কৃষ্ণ বিবরের ভেতরে লাফ দিল। এখন সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের কোয়ান্টাম তত্ত্ব ব্যতীত বলা সম্ভব নয়, তার ভাগ্যে কী ঘটবে। আর আমরা যদি সাবধানতা অবলম্বন করি, কখনো কৃষ্ণ বিবরের ধারে–কাছে না যাই, তাহলে এই তথ্য আমাদের কাছে অধরাই থেকে যাবে। কেন যেন প্রকৃতি আমাদের কাছ থেকে এই ব্যাপারটা লুকিয়ে রাখতে চায়। গত লেখাতেই প্ল্যাঙ্ক স্কেল সম্পর্কে বলা হয়েছে। ব্ল্যাক হোলের রহস্য জানতে হলে এই প্ল্যাঙ্ক স্কেলে প্রকৃতি কোন সূত্র বা নিয়ম মেনে চলে, তা আমাদের জানতে হবে। আর সেই সূত্র হতে হবে মহাকর্ষীয় বলের কোয়ান্টাম তত্ত্ব। স্ট্রিং তত্ত্ব হচ্ছে এমনই একটা তত্ত্ব।
ড. সাজিদ হক: শিক্ষক ও গবেষক, স্ট্রিং থিওরি অ্যান্ড কসমোলজি, ইউনিভার্সিটি অব উইন্ডসর, কানাডা
ই-মেইল: shajidhaque@gmail.com
ই-মেইল: shajidhaque@gmail.com