এই বাস্তবতায় এরই মধ্যে ইউরোপীয় প্রতিবেশীরা যুক্তরাজ্যের ভ্রমণকারীদের জন্য দরজা বন্ধ করা শুরু করেছে। জার্মানির সরকারও যুক্তরাজ্যের সব ফ্লাইটে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। আত্মরক্ষার তাগিদে সৌদি আরবও গতকাল থেকে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চলাচলে এক সপ্তাহের নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করেছে। এদিকে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বেড়ে চলায় পুরো অস্ট্রেলিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা হয়েছে রাজধানী সিডনিকে। করোনার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় রবিবার এ সিদ্ধান্তটি ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ।
ব্রিটেনের দরজা বন্ধ : গত শনিবার যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ও বিজ্ঞানীরা দেশটিতে করোনাভাইরাসের একটি নতুন রূপ শনাক্তের কথা ঘোষণা করে এ ধরনটি ৭০ শতাংশ বেশি সংক্রামক বলে জানিয়েছেন। এরপর রবিবার যুক্তরাজ্য থেকে ফ্লাইট চলাচলে নিষেধাজ্ঞাসহ বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপ করেছে নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, জার্মানি ও ইতালি। রবিবার রাত থেকে পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টার জন্য যুক্তরাজ্য থেকে আসা সবার প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ফ্রান্স। সড়ক, সমুদ্র, রেল ও আকাশপথে মালামাল বহন করে নিয়ে আসা লোকজনও এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়বে বলে দেশটি জানিয়েছে।আয়ারল্যান্ড জানিয়েছে, রবিবার মধ্যরাত থেকেই তারা প্রতিবেশী দেশটির ফ্লাইট এবং ফেরি চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। প্রাথমিকভাবে ৪৮ ঘণ্টা এই বিধিনিষেধ জারি রাখা হবে। বেলজিয়াম জানিয়েছে, তারা রবিবার মধ্যরাত থেকে যুক্তরাজ্য থেকে আসা জনপ্রিয় ইউরোস্টার সার্ভিসসহ ট্রেন, ফ্লাইটের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী আলেকজান্দ্রার দোকো টিভি চ্যানেল ভিআরটিতে বলেছেন, ‘পূর্বসতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে এই নিষেধাজ্ঞা অন্তত ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। আরও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন কিনা সেটি আমরা পরে দেখব।’
ইতালির স্বাস্থ্যমন্ত্রী রোবের্তো স্পেরানজা বলেছেন, ‘সম্প্রতি লন্ডনে আবিষ্কৃত কভিডের ধরনটি উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো। আমাদের বিজ্ঞানীদেরও এটি পরীক্ষা করে দেখা দরকার। এর মধ্যে আমরা সবচেয়ে বিচক্ষণ পথটি বেছে নিয়েছি।’ ইতালি, যুক্তরাজ্য থেকে ছেড়ে আসা সব ধরনের ফ্লাইটে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এর পাশাপাশি গত ১৪ দিনের মধ্যে ব্রিটেন ঘুরে আসা সবার ইতালি প্রবেশেও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দেশটি। জার্মানির স্বাস্থ্যমন্ত্রী ইয়েনস ইসপান সরকারি গণমাধ্যম এআরডিকে বলেছেন, ‘এটি (ভাইরাসের এই মিউটেশনটি) এখনও জার্মানিতে পাওয়া যায়নি, কিন্তু অবশ্যই ব্রিটেন থেকে আসা প্রতিবেদনগুলোকে আমরা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি।’ নেদারল্যান্ডস রবিবার থেকে যুক্তরাজ্যের সব যাত্রীবাহী ফ্লাইটের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে ১ জানুয়ারি পর্যন্ত এটি বজায় থাকবে বলে জানিয়েছে। অস্ট্রিয়া সরকারও যুক্তরাজ্য থেকে ফ্লাইট নিষিদ্ধ করার পরিকল্পনা করছে বলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে জানিয়েছে দেশটির গণমাধ্যম। অন্যদিকে স্পেনও ইইউ দেশগুলোর সঙ্গে সমন্বয়ের ভিত্তিতে যুক্তরাজ্যের ফ্লাইট বন্ধের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে চায় বলে জানিয়েছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী। সুইডেন জানিয়েছে, যুক্তরাজ্য থেকে তাদের দেশে প্রবেশের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা। রোমানিয়া, লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া, এস্তোনিয়া, বুলগেরিয়া ও চেক রিপাবলিকও যুক্তরাজ্যের ফ্লাইটের ওপর নিষেধাজ্ঞার পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে।
আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে নিষেধাজ্ঞা সৌদি আরবের : করোনাভাইরাসের প্রকোপ বাড়তে থাকায় গতকাল থেকে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চলাচলে এক সপ্তাহের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে সৌদি আরব সরকার। সৌদি আরবের এয়ারলাইন্স সাউদিয়ার এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ২১ ডিসেম্বর প্রথম প্রহর থেকে এক সপ্তাহের এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করেছে সৌদি সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ। এ নিষেধাজ্ঞা আরও এক সপ্তাহ বাড়ানো হতে পারে। আকাশ পথের মতো স্থল ও সমুদ্রবন্দরের ক্ষেত্রেও এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা হয়েছে বলে জানিয়েছে সৌদি আরবের বার্তা সংস্থা এসপিএ।
অস্ট্রেলিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন সিডনি : বিশ্বজুড়ে তা-ব চালাচ্ছে করোনাভাইরাস। এ অবস্থায় দ্য অস্ট্রেলিয়ান ক্যাপিটাল টেরিটরি (এসিটি) সিডনির বাসিন্দাদের কাছে সতর্কবার্তা পাঠিয়েছে। ৫০ লাখ বাসিন্দার উদ্দেশে বলা হয়েছে, ‘আমাদের কাছে আসবেন না।’ নগরী থেকে বের হলেই ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে পাঠানোর কথাও বলা হয়েছে এতে। এসিটির স্বাস্থ্য বিভাগ বলেছে, ‘আপনি যদি এসিটির বাসিন্দা না হন এবং সিডনিতে অবস্থান করে থাকেন, আমাদের বার্তা একেবারেই সাধারণ এসিটিতে ভ্রমণ করবেন না।’
গতকাল থেকে ভিক্টোরিয়া ও কুইন্সল্যান্ড রাজ্য এবং নর্দার্ন টেরিটরির বাসিন্দাদের সিডনিতে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। সিডনিতে প্রবেশ ঠেকাতে নিউ সাউথ ওয়েলসে কুইন্সল্যান্ডের পুলিশ তল্লাশি চৌকি বসিয়েছে। সাউথ অস্ট্রেলিয়া রাজ্য সিডনি থেকে আসা লোকদের জন্য ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইন ঘোষণা করেছে। শনিবার একই ঘোষণা দিয়েছিল তাসমানিয়া। ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া রাজ্য সীমান্তে আরও কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। নিউ সাউথ ওয়েলস থেকে আসা যেকোনো ব্যক্তিকে এই রাজ্যে প্রবেশ করতে হলে তাকে প্রমাণপত্র দেখাতে হবে যে, তিনি সিডনির সংক্রমিত এলাকা থেকে আসেননি।
ইতালিতেও নতুন প্রজাতির করোনা : যুক্তরাজ্যের পর এবার ইতালিতেও নতুন প্রজাতির করোনাভাইরাসে আক্রান্ত একজন রোগী শনাক্ত হয়েছে। রবিবার দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে। মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, যুক্তরাজ্যে নতুন যে প্রজাতির সন্ধান পাওয়া গেছে ওই ইতালীয় নাগরিকের শরীরেও সেই একই প্রজাতির করোনাভাইরাস পাওয়া গেছে। বর্তমানে আইসোলেশনে থাকা ওই ব্যক্তি কিছুদিন আগে এক ফ্লাইটে তার সঙ্গীকে নিয়ে যুক্তরাজ্য থেকে দেশে ফেরেন বলে জানা গেছে।
ইংল্যান্ডে আবার লকডাউন : যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ম্যাট হ্যানকক জানিয়েছেন, নতুন প্রজাতির এই ভাইরাস থেকে ফের সংক্রমণ ছড়াচ্ছে এবং তার গতি আগের চেয়েও বেশি। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে শনিবার লন্ডনসহ দক্ষিণ ইংল্যান্ডে আবারও লকডাউন জারির ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। নতুন প্রজাতির করোনাভাইরাস আগের চেয়ে দ্রুত সংক্রমণ ছড়াচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে তা আগের প্রজাতির চেয়ে বেশি প্রাণঘাতী নয় বলে মনে করা হচ্ছে। নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক ও অস্ট্রেলিয়াতেও এই নতুন প্রজাতির উপস্থিতি পাওয়া গেছে। তবে এ প্রজাতি করোনা ভ্যাকসিনের বিরুদ্ধে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখায় বলে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ডব্লিউএইচও জানিয়েছে, যুক্তরাজ্য করোনাভাইরাসের রূপান্তরের তথ্য তাদের সঙ্গে বিনিময় করছে। সংস্থার পক্ষ থেকে সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে এই বিষয়ে অবহিত করার উদ্যোগ নিচ্ছে।
কেন এত উদ্বেগ : নতুন করোনাভাইরাসের কারণে পরিস্থিতিকে ‘সত্যিকারের উদ্বেগের কারণ’ বলে মনে করা হচ্ছে। করোনা মহামারী আকারে দেখা দেওয়ার পর থেকে এবারই প্রথম রূপান্তর বা জিনগত পরিবর্তনের কারণে ভাইরাসটির সংক্রমণ বেড়েছে, তা নয়। তবে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণের পর ধারণা করা হচ্ছে এই ছড়িয়ে পড়ার হার ৭০ শতাংশ কিংবা তার চেয়েও বেশি।
স্কাই নিউজের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত মানব শরীরকে আক্রান্ত করা কভিড-১৯ এর অন্তত সাতটি বড় গ্রুপ কিংবা স্ট্রেইন পাওয়া গেছে। মূল স্ট্রেইনটি আবিষ্কার হয়েছে গত বছরের ডিসেম্বরে চীনের উহান শহরে। এর নাম ‘এল স্ট্রেইন’। এরপর ২০২০ সালের শুরুর দিকে এর রূপান্তর হয়ে এস স্ট্রেইন হয়। এরপর আবারও রূপান্তরের মধ্য দিয়ে উদ্ভব হয় ভি ও জি স্ট্রেইনের।
ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকাতে সাধারণত করোনাভাইরাসের স্ট্রেইন জি দেখা যায়। তবে এসব মহাদেশে মানুষের চলাচলের ওপর বিধি-নিষেধ শিথিল থাকার কারণে দ্রুত এ ভাইরাস ছড়িয়েছে এবং জিআর, জিএইচ ও জিভি স্ট্রেইনের উদ্ভব হয়েছে। এদিকে আবার এশিয়াতে মূল স্ট্রেইন এল-এর উপস্থিতি অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ সময়ের জন্য ছিল। কারণ চীনসহ বিভিন্ন দেশ দ্রুত তাদের সীমান্ত বন্ধ করে দিয়ে চলাফেরায় বিধি-নিষেধ আরোপ করায় এর রূপান্তর হয়নি। এছাড়া অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত কিছু স্ট্রেইনকে একসঙ্গে ‘স্ট্রেইন ও’ নামে ডাকা হয়ে থাকে। বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে বেশি আধিপত্যকারী স্ট্রেইন হলো জি স্ট্রেইনস। বিশেষ করে ইতালি ও ইউরোপে প্রাদুর্ভাবের পেছনে এটি দায়ী। সুনির্দিষ্ট মিউটেশনটি হলো ডি৬১৪জি। এটি সবচেয়ে পরিচিত রূপান্তর। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এ রূপান্তরের মধ্য দিয়ে ভাইরাস আরও বেশি সংক্রামক হয়ে উঠতে পারে। তবে কিছু গবেষণা আবার এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এরই মধ্যে মূল এল স্ট্রেইন ও ভি স্ট্রেইনের মতো শুরুর দিককার স্ট্রেইনগুলো ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হচ্ছে। রয়টার্সের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, মহামারী মোকাবিলায় দৃঢ় পদক্ষেপ ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে কার্যকরী পদক্ষেপের মধ্যদিয়ে অস্ট্রেলিয়া এল ও এস স্ট্রেইনের সংক্রমণ রোধ করতে পেরেছে। আর জি স্ট্রেইনের কারণে যে নতুন সংক্রমণ দেখা গেছে তা এসেছে বিদেশ ফেরতদের মাধ্যমে। মার্চের শুরু থেকেই এশিয়াতে জি, জিএইচ ও জিআর স্ট্রেইনের প্রকোপ বাড়তে দেখা গেছে। এক মাসেরও বেশি সময় আগে থেকে এ স্ট্রেইন ইউরোপে ছড়িয়েছে। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দক্ষিণ-পূর্ব ইংল্যান্ডে ৪৩ শতাংশ নতুন সংক্রমণ, পূর্ব ইংল্যান্ডে ৫৯ শতাংশ এবং লন্ডনে ৬২ শতাংশ নতুন সংক্রমণের পেছনে এ রূপান্তরিত স্ট্রেইন দায়ী। ইংল্যান্ডের প্রধান মেডিক্যাল কর্মকর্তা অধ্যাপক ক্রিস হুইটি বলেন, ‘গত কয়েক সপ্তাহে খুব দ্রুত এর সংক্রমণ বেড়েছে।’ প্রধান বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা প্যাট্রিক ভ্যালান্স বলেন, ‘অস্বাভাবিকভাবে বড় সংখ্যায় এর রূপান্তর দেখা গেছে।’ করোনাভাইরাসের নতুন এ স্ট্রেইনটির ২৩টি ভিন্ন ভিন্ন পরিবর্তন দেখা গেছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছেন, ভাইরাসের নতুন রূপান্তরিত স্ট্রেইন (ভিইউআই-২০২০১২/০১) ৭০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি সংক্রামক হতে পারে। এটি আর নাম্বার ০.৪ বাড়িয়ে দিতে পারে।