
আমার পাঁচ বছর বয়সী মেয়ে ডাইনোসরের মহাভক্ত। একদিন সে আমার কাছে এল ডাইনোসর-বিষয়ক একটা বই হাতে নিয়ে। সেখান থেকে সে আমাকে একটা বিশেষ ডাইনোসরের ছবি দেখাল, যার নাকে একটা গোলাপি রঙের শুণ্ড (Snout) আছে। সে আমার কাছে জানতে চাইল, এটা কেন আছে? পাঠক নিশ্চয় অনুমান করতে পারছেন আমার থিওরি অব এভরিথিংয়ের জ্ঞান সেদিন তেমন কোনো কাজে আসেনি। তবে আমি বাচ্চাদের সঙ্গে যতটা সম্ভব সৎ থাকার চেষ্টা করি। তাই আমি ওকে কোনো মনগড়া কাল্পনিক উত্তর দিইনি। শুধু বলেছিলাম, আমি জানি না। সে এরপর চলে গেল তার মায়ের কাছে এবং প্রশ্নের বিভিন্ন ধরনের উত্তর পেল। তবে কোনো উত্তরই তার পছন্দ হলো না। শেষমেশ সে নিজে ভেবে একটা উত্তর দাঁড় করাল। ‘এই প্রজাতির ডাইনোসররা ফুল খুব পছন্দ করে। যেহেতু বেশির ভাগ ফুলই গোলাপি রঙের হয়, তাই এই ডাইনোসরদের গোলাপি রঙের শুণ্ড আছে।’

স্ট্রিং তত্ত্ব মূলত তিনটি বিষয়কে একীভূত করতে চায়। এক. পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন তত্ত্ব; দুই. প্রকৃতির মৌলিক বলসমূহ এবং তিন. প্রকৃতির মৌলিক কণাসমূহ।
আমি আজ তিন নম্বর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে চাইছি। কারণ, বিষয়টি স্ট্রিং তত্ত্বের কেন্দ্রীয় ভাবনা নিয়ে আলোকপাত করে। এ ছাড়া এটাই সম্ভবত স্ট্রিং তত্ত্বের জন্ম নিয়ে কথা বলার জন্য আদর্শ জায়গা।

তাহলে প্রশ্ন হলো এটা কি প্রমাণ করে যে সমীকরণটা ভুল? ঠিক তা না আসলে।
আরও গোড়া থেকে শুরু করা যাক। পদার্থবিজ্ঞানে আসলে আমরা কী করি? গণিত ব্যবহার করে আমরা কতগুলো পরিমাপক সংজ্ঞায়িত করি, যাদের কিছু গাণিতিক আর কিছু ভৌত। ভৌত পরিমাপকগুলো আমরা পরীক্ষাগারে মাপতে পারি। যখন আমরা পরিমাপ করি, তখন এটা জানা আবশ্যক যে পরিমাপের স্কেলটা কী। ম্যাকক্রোসকপিক ইভেন্টে আমরা আসলে মাইক্রোসকপিক্যালি পরিমাপকের সংজ্ঞাটা ব্যর্থ হলো কি না, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করি না। কিন্তু দিন শেষে এটা একটা প্র্যাকটিক্যাল স্ট্যান্ড পয়েন্ট। ধরা যাক, আমরা আসলে জানতে চাই মাইক্রোসকপিক্যালি কী হচ্ছে? লক্ষ করুন যে ‘অসীম’টা আমরা পাচ্ছি, তা আসলে কণাকে বিন্দুর মতো চিন্তা করার জন্য হচ্ছে। এই সমস্যা থেকে বের হতে হলে আমাদের ধরে নিতে হবে, প্রকৃতির একটা সর্বনিম্ন দৈর্ঘ্য আছে। এটাকে আমরা প্ল্যাঙ্ক দৈর্ঘ্য বলি। এটি ১০ টু দ্য পাওয়ার-৩৩ সেন্টিমিটার (দশমিকের পর ৩২টা শূন্য তারপর এক) বা শক্তি এককে ১০ টু দ্য পাওয়ার ১৯ জিইভির (গিগা ইলেকট্রন ভোল্ট) সমান। এখানেই স্ট্রিং থিওরির ব্যুৎপত্তি। স্ট্রিং থিওরি বলে আমাদের প্রকৃতির মৌলিক বিল্ডিং ব্লক হলো এক মাত্রার সুতা বা তন্তুর মতো বস্তু, যার দৈর্ঘ্য প্ল্যাঙ্কের দৈর্ঘ্যের কাছাকাছি।

এই তত্ত্ব অনুযায়ী আমাদের প্রকৃতির মৌলিক বিল্ডিং ব্লক হচ্ছে শুধুই একধরনের অতি ক্ষুদ্র তন্তু (স্ট্রিং), আর কিছু না। এই তন্তুর বিভিন্ন ধরনের কম্পনের ফলে ভিন্ন ভিন্ন কণার উৎপত্তি হয়। এভাবেই স্ট্রিং সব কণাকে এক মালায় গাঁথে। আগেই বলা হয়েছে, এই স্ট্রিং খুবই ছোট (১০ টু দ্য পাওয়ার-৩২ বা শক্তি এককে ১০ টু দ্য পাওয়ার ১৪ গিগা ইলেকট্রন ভোল্ট)। পাঠকের সুবিধার্থে এই সংখ্যাগুলো সম্পর্কে একটু অন্যভাবে ধারণা দেওয়া যাক। আমরা সবাই আমাদের সৌরজগৎ সম্পর্কে জানি। আমাদের সৌরজগতের দৈর্ঘ্য (ব্যাস) কী হতে পারে, তার একটা ধারণা আমরা পাই পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব চিন্তা করলে। এখন এ ধরনের বিলিয়ন বিলিয়ন সৌরজগৎ মিলে একটা গ্যালাক্সি হয়। কাজেই তাঁর দৈর্ঘ্য কী হতে পারে, তা কল্পনা করাও কঠিন। এখন এ রকম প্রায় এক বিলিয়ন গ্যালাক্সির দৈর্ঘ্য আমাদের হাতের নখের দৈর্ঘ্যের তুলনায় যে রকম বড়, হাতের নখটা একটা স্ট্রিংয়ের তুলনায় সে রকমই বড়। কাজেই পর্যবেক্ষণ করার কোনো প্রশ্নই আপাতত আসে না।
ড. সাজিদ হক: শিক্ষক ও গবেষক, স্ট্রিং থিওরি অ্যান্ড কসমোলজি, ইউনিভার্সিটি অব উইন্ডসর, কানাডা
ই-মেইল: shajidhaque@gmail.com
ই-মেইল: shajidhaque@gmail.com