রবিবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২২

দু একবার ভাবলাম প্রশ্নটি এড়িয়ে যাওয়াই ভালো, তারপরে মনে হল হয়ত আমার উত্তর একটি মেয়েকে সত্যি সাহায্য করতে পারে। এই উত্তর দিচ্ছি সেই সব মহিলাদের জন্যেই, যারা শ্বশুরবাড়িতে থাকতে চান, আর্থিক কারণে অথবা সামাজিক কারণে। যারা মনে করেন, কোন ব্যাপারেই মানিয়ে নেওয়ার দরকার নেই, তাঁদের জন্যে এই পরামর্শ গুলি নয়। আমি নিজে বিয়ের সময় আর্থিকভাবে স্বনির্ভর ছিলাম, কিছু জিনিস মানিয়ে নিয়েছি সংসারে, তাতে আমার খুব বেশি ক্ষতিবৃদ্ধি হয় নি আবার আমার শাশুড়িও কিছু জিনিস মানিয়ে নিয়েছেন; এই সব করতে করতে ৯ বছর বাদে এসে আমাদের সম্পর্ক কিন্তু যথেষ্ট ভালো এবং যে কোন প্রয়োজনে আমার শ্বাশুড়ী আমার বরের থেকে আমার উপরে অনেক বেশি নির্ভর করেন। নিচের পরামর্শ গুলি আমার নিজের জীবন দিয়ে শেখা কিছু উপলব্ধি।

১। সময় নিনঃ প্রথম শ্বশুরবাড়িতে এসেই ভালো বউ হওয়ার জন্যে সমস্ত দায়িত্ব ঘাড়ে নেওয়ার দরকার নেই; আবার উল্টোদিকে সমস্ত অপছন্দের ব্যপারে প্রতিবাদ করারও দরকার নেই। কারণ এক মাঘে শীত যায় না। আপনার হাতে অনেক দিন সময় আছে, অল্প স্বল্প মানিয়ে চলুন। আপনার মানানোর ক্ষমতা কতটা সেটা আগে বুঝে নেবেন… মানে আপনাকে যদি চাকরি ছাড়তে বলা হয় অথবা আপনার বাবামায়ের নামে ক্রমাগত অপমানজনক মন্তব্য করা হয় অথবা শারীরিক নিগ্রহ করা হয়, মানিয়ে নেবেন না। কিন্তু যদি সকালে একটু আগে ঘুম থেকে উঠতে বলা হয় এবং তার জন্যে আপনার বিশাল কিছু কষ্ট না হয়, তাহলে এটা একটু মানিয়ে নেওয়াই যায়। একবার যদি আপনার শাশুড়ি নিশ্চিত হন, যে আপনি তার সংসারে মানিয়ে গুছিয়ে থাকতে এসেছেন এবং তাঁকে যথোপযুক্ত সন্মান দিচ্ছেন, তাহলে নিজে থেকেই তিনি অনেক নরম হয়ে যাবেন এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অল্পদিনের মধ্যেই আপনি সংসারের একজন হয়ে যাবেন।

২। বক্তব্য প্রকাশ করুন শান্তভাবেঃ সব কথাতেই চিল্লামিল্লি করলে, তাতে কোন পক্ষেরই কোন সুবিধা হয় না। তাঁর চাইতে কোন ব্যাপারে মনোমালিন্য হলে, কিছু সময় বাদে শান্ত হওয়ার পরে আপনার যুক্তি বোঝান। একদিনে হয়ত তিনি বুঝবেন না। তবে এক বছর বাদে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখবেন আপনার প্রতি তার অত বৈরীভাব নেই।

৩। অন্য সম্পর্ক গুলিকে গুরুত্ব দিনঃ শাশুড়ির সাথে বৌমার সম্পর্ক খারাপ হওয়াটা আমাদের দেশের নিরিখ স্বাভাবিক। এবং আপনার ননদ-দেবরেরাও হয়ত প্রথম মায়ের পক্ষ নিয়ে আপনার বিরুদ্ধে থাকতে পারে। তবে আপনার সাথে তাঁদের ব্যবহারে যেন কোন বৈরিতা প্রকাশ না পায়। ননদ বা দেবর আপনার প্রতিপক্ষ নন। তারা মাকে বেশি ভালোবাসলেও, চোখে অন্ধ নয়। নিজেদের বিচারবুদ্ধি লাগিয়ে তারা আপনার ভালো দিকগুলিও ঠিক খুজে পাবে, আজ না হয় কাল। ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা বলি… আমার ননদ আমার থেকে প্রায় ৯ বছরের ছোট। আমার ছাত্রছাত্রীদের থেকেও ছোট বলা যায় ওকে। আমি প্রথম থেকেই তাকে আমার নিজেরর বোনের মত দেখেছি। শাড়ী, গয়না সাজগোজ সব কিছু ব্যবহার করতে দিয়েছি। পরবর্তীকালে ও কিন্তু অনেক সময়েই মাকে আমার পক্ষ নিয়ে বুঝিয়েছে। এবং এখন বিয়ের পরে, ও নিজেও অনেক জিনিষ বুঝতে শিখেছে এবং আমার প্রথম দিকের অসুবিধা গুলি অনেক ভালো অনুভব করে।

৪। বরকে সব ব্যাপারে জড়াবেন নাঃপ্রতিটা মানুষেরই কিছু ভুল ত্রুটি থাকে, প্রজন্মের পার্থক্যে এসব আরো বেশি হয়ে যায়। আপনার সাথে অনেক কিছুতেই আপনার শ্বাশুড়ীর মতবিরোধ হবে। হয়ত অনেক ব্যাপারেই উনি ভুল। কিন্তু আপনি যদি আশা করেন যে আপনার স্বামী তাঁকে চোখে আঙুল দিয়ে সেই ভুলগুলি দেখিয়ে দেবে, সেটা ঠিক নয়। ভেতরে ভেতরে বুঝতে পারলেও, একটি ছেলের পক্ষে সর্বদা সম্ভব হয় না মায়ের দোষ ত্রুটি গুলি মুখের উপর বলা। হয়ত আপনার সামনে আপনার মাকে কেউ বললেও আপনার একই রকম অনুভব হত।

৫। শাশুড়ি নিজের ছেলেকে আপনার থেকে বেশি ভালোবাসেন, খুব স্বাভাবিক। আপনার মাও আপনাকে জামাইয়ের থেকে বেশি ভালোবাসেন। কিন্তু মেয়ের মায়েদের মধ্যে জামাইকে খুশি করার একটা প্রবণতা থাকে, যেটা ছেলের মায়েদের থাকে না, তাই ভালোবাসাটা প্রকাশ হয়ে পড়ে। হয়ত আপনার খারাপ লাগবে। মানিয়ে নিতে পারলে, ভালো। তবে এই ব্যাপারটাও খুব অল্পও সময়ের জন্যে। ধীরে ধীরে তিনি আপনাকেও ভালোবাসবেন।

৬। চুপ করে থাকুনঃ অনেক সময়েই তাঁদের ভুল ত্রুটি গুলো ধরিয়ে দিলে, তারা আরো রেগে যান এবং অনেক বেশি চিল্লামিল্লি করেন। এক্ষেত্রে চুপ করে থাকলে অনেক সময়েই লাভ হয়।

তবে আমি ব্যাক্তিগত ভাবে কোনদিনই চুপ থাকতে পারিনি। কারোর ভুল দেখলে মুখের উপর না বলা পর্যন্ত আমার শান্তি হয়না। যাই হোক, এখন আমার শাশুড়িও ব্যাপারটা জেনে গেছেন, অত কিছু মনে করেন না। এ ব্যাপারে আমার বাবা একটা কথা বলতেন যে “তোমার লড়াইটা অনেক বড়। সংসারে শ্বাশুড়ীর বিরুদ্ধে ঝগড়ায় জিতে তোমার জীবনে কোন মোক্ষ লাভ হবে না; ওনার ভুলগুলি থেকে শিক্ষা নাও, যাতে ভবিষ্যতে ঐ ভুলগুলি তোমার যেন না হয়”…

এতক্ষণ বললাম পছন্দের বৌমা হয়ে ওঠার কথাগুলি। এবারে বলব শাশুড়িকে বশে আনা বা প্রভাবিত করার জন্যে কিছু টিপ্সঃ

১। প্রত্যক মানুষের জীবনেই কিছু বঞ্চনার অতীত থাকে। সে জায়গা গুলি খুঁজে বার করুন। হয়ত তিনি কোনদিন স্বাধীনতা পাননি জীবনে। হয়ত কোনদিন কেউ তার রান্নার প্রশংসা করে না, অথচ একদিন তরকারিতে ঝাল কম হলে সবাই মিলে কথা শোনায়। হয়ত কোনদিন কেউ তার পছন্দের খাবার রান্না করে খাওয়ায় নি। চেষ্টা করুন তার পছন্দের খাবার একদিন রান্না করে খাওয়াতে। কোন অপূর্ণ শখ থাকলে পূরণ করার চেষ্টা করুনঃ হতে পারে সেই শখটি একটি ভালো শাড়ী, নাগরদোলায় চড়া অথবা মেলায় ঘোরা অথবা বিউটি পার্লারে যাওয়া অথবা শখের চুল কাটা অথবা সমুদ্র সৈকতে জিনস টপ পরে ঘোরা। সাধ্যের মধ্যে হলে অবশ্যই করুন আর তার পরিবর্তে ওনার থেকে কৃতজ্ঞতা আশা করবেন না। মুখে কিছু না বললেও, কথাটা তিনি মনে রাখবেন।

২। বাইরের লোকের কাছে শাশুড়ির প্রশংসা করুন। আপনার বন্ধু যদি একদিন বাড়িতে এসে বলে “খালা, আপনি তো দারুণ কলিজা ভুনা বানান, মিলি বলছিল”, তিনি অবশ্যই খুশি হবেন।

৩। আধুনিক বিষয় তাকে বুঝিয়ে বলুন। আমি প্রথম যখন ‘তথ্যপ্রযুক্তি’ পড়তে গেলাম, আমাকে আমার ঠাকুমা জিজ্ঞাসা করলেন বিষয়টি কি। আমি একটা দায়সারা উত্তর দিলাম, ভাবলাম ঠাকুমা এসবের কি বুঝবেন! আমার মা শুনে বললেন “তুমি যদি একজন শিক্ষিত মানুষ হয়ে একজন প্রাথমিকের শিশুকে বোঝাতে না পার তোমার পড়ার বিষয়টি, তাহলে তোমাকে আমরা বৃথাই পড়াশোনা শিখিয়েছি” … এর পরে আমি ঠাকুমাকে বিষয়টি বুঝিয়েছিলাম। সেরকম ভাবে শাশুড়িকেও অনেক জিনিষ সহজ ভাষায় বুঝিয়েছি, যেগুলো অন্যদের কাছে জিজ্ঞাসা করলে ‘ও তুমি বুঝবা না’ বলে হেয় করে।

আমি সব মেয়েদেরকে তাই বলবঃ

ক) রান্নাঘর আর শাশুড়ির বাইরেও একটা বিশাল জগত আছে, সেখানে যুদ্ধ করে নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখ। একজন মহিলা যিনি জীবনে তোমার থেকে অনেক কম দেখেছেন (বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হয়ত তিনি পড়াশুনা অতটা করেননি বা চাকরি করেন নি), তাঁকে আচ্ছা করে বুঝিয়ে দিয়ে বৃহত্তর নারীবাদের কোন উপকার করছ না তুমি। বরং তা মহিলাদের পিছিয়ে যাওয়ায় উৎসাহিত করছে। একজন এইচ এস সি পাশ মহিলা যদি দেখেন তার এম এ পাস বৌমা এসে তার মতই করে গলা বাড়িয়ে ঝগড়া করছেন, তাহলে পড়াশুনার উপর তার বিশ্বাস উঠে যাবে।

খ) শাশুড়ি তোমার মা নন এবং তুমিও তার মেয়ে নন। হয়ে ওঠার চেষ্টা করার মানে হয় না। কারণ মা ছাড়াও তুমি এতদিনের জীবনে অনেক মহিলাকে ভালোবেসেছ, জ্যেঠিমা, কাকিমা, পিসিমা, মাসিমা, দিদি, শিক্ষিকা, কলেজের সিনিয়র… সবাইকে তুমি কি মায়ের আসনে বসাতে গিয়েছ? অথচ তাঁদের তো তুমি শ্রদ্ধা সন্মান কম কর না। তাহলে এখনো তাই কর

গ) শাশুড়ির ভরসার জায়গা, আব্দারের জায়গা হয়ে ওঠার চেষ্টা কর।

ঘ)শারীরিক নিগ্রহ মেনে নিও না

ঙ) নিজের সাধ্যের বাইরে গিয়ে অতিরিক্ত মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা কর না। কোন রকম অসুবিধা হলে, কাছের বন্ধুদের সাথে কথা বল। পরামর্শ নাও, কিন্তু গুমরে মরো না। দরকার হলে সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে এস।

কোন মন্তব্য নেই: