Translate

সোমবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৮

ইন্টারস্টেলার স্পেসের প্রান্তে ভয়েজার–২

ছবি: ভয়েজার ২ছবি: ভয়েজার ২মহাকাশবিজ্ঞানের ইতিহাসে আরেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। ৪১ বছর পর ইন্টারস্টেলার স্পেসে ঢুকতে চলেছে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান নাসার তৈরি ভয়েজার–২ নভোযান। গত আগস্ট মাস থেকে ভয়েজার–২ মহাকাশযান মহাজাগতিক রশ্মি বৃদ্ধির মুখে পড়েছে।
১৯৭৭ সালে মহাকাশে পাঠানো হয় এই যান। গবেষকেরা বলছেন, ভয়েজার–২ যে রশ্মির মুখোমুখি হয়েছে, তা সৌরজগতের বাইরে উদ্ভূত। এ রশ্মি থেকেই বোঝা যায়, মহাকাশযানটি ইন্টারস্টেলার স্পেসের কাছাকাছি পৌঁছেছে। বর্তমানে এটি হেলিওপজ এলাকা অতিক্রম করছে। ওই এলাকা সৌরঝড়ে তৈরি বুদ্‌বুদের প্রান্ত বা হেলিওস্ফেয়ার হিসেবে পরিচিত। এর আগে ২০১২ সালের মে মাসে ভয়েজার–১ নভোযানটিও একই ধরনের রশ্মির মুখোমুখি হয়েছিল। হেলিওস্ফিয়ারের বাইরের সীমানা, অর্থাৎ হেলিওপোজে পৌঁছানোর জন্য মহাকাশযানটির দিকে লক্ষ রাখছিলেন মহাকাশযানবিদেরা।
Ispahani Tea
এনডিটিভির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, হেলিওস্ফেয়ার হলো সূর্যের চারপাশে ও গ্রহগুলোর চারপাশের সুবিশাল বুদ্‌বুদ, যা সৌর উপাদান এবং চুম্বকক্ষেত্র দ্বারা প্রভাবিত। ভয়েজার–১–এর পরে এটিই মানুষের তৈরি দ্বিতীয় মহাকাশ যান, যা ইন্টারস্টেলার স্পেসে ভ্রমণ করবে। বর্তমানে পৃথিবী থেকে ১৭ দশমিক ৭ বিলিয়ন কিলোমিটার দূরত্বে রয়েছে ভয়েজার–২। এ মহাকাশযান বৃহস্পতি (১৯৭৯), শনি (১৯৮১) ইউরেনাস (১৯৮১) ও নেপচুন (১৯৮৯) ভ্রমণ করেছে।

গবেষকেরা বলছেন, ভয়েজার–২–এর অবস্থান ও পরিভ্রমণপথ পৃথক। তাই এটি কখন সৌরজগৎ ছাড়িয়ে যাবে, তা ঠিক বলা যায় না। হেলিওস্ফেয়ারের সীমানা পরিবর্তিত হয়। সূর্যের ১১ বছরের চক্রে এ সীমানা পরিবর্তন হয়ে থাকে। তাই কবে নাগাদ সূর্যের বলয় থেকে ওই নভোযানটি বেরিয়ে যাবে, তা ঠিক বলা যায় না।
ক্যালিফোর্নিয়ায় নাসার জেট প্রপালশন ল্যাবরেটরির গবেষক এড স্টোন বলেছেন, আগস্টের শেষ দিক থেকেই কসমিক রে সাবসিস্টেম ভয়েজার–২ মহাজাগতিক রশ্মির বৃদ্ধি লক্ষ্য করে, যা গত বছরের থেকে ৫ শতাংশ বেশি।

সৌরজগৎ পেরিয়ে গেছে ভয়েজার!

ভয়েজার ১ভয়েজার ১সৌরজগতের প্রান্তসীমা ছাড়িয়ে মহাকাশযান ভয়েজার এখন অসীমের পথে ছুটে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ম্যারিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানী মার্ক সুইসডাক এক সাক্ষাত্কারে বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, ২০১২ সালেই সৌরজগত্ ছেড়ে গেছে নাসার পাঠানো এই নভোযান। এই প্রথম মানুষের তৈরি কোনো নভোযানের সৌরজগৎ ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রমাণ পেয়েছেন তাঁরা।
এর আগে চলতি বছরের জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান নাসার গবেষকেরা জানিয়েছিলেন, সৌরজগৎ ছাড়িয়ে যেতে বড়জোর আরও কয়েক বছর লাগতে পারে ভয়েজারের। তবে এ গবেষণা সঠিক নয় বলে ম্যারিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষক মার্ক সুইসডাক দাবি করেছেন, গত বছরেই সৌরজগতের প্রান্তসীমা অতিক্রম করে গেছে ভয়েজার।
মার্ক সুইসডাকের দাবি, ভয়েজারে যখন চৌম্বকক্ষেত্রের বিশাল তারতম্য ধরা পড়েছিল তখনই সৌরজগৎ ছাড়িয়ে গেছে ভয়েজার।
সুইসডাকের নতুন এ গবেষণা সম্পর্কে নাসার গবেষক এজ স্টোন জানিয়েছেন, কম্পিউটার মডেলের ওপর ভিত্তি করে যে ফল পাওয়া গেছে তাতে একেক সময় একেক ফল দেখায়। তবে, ম্যারিল্যান্ডের গবেষকেদের করা গবেষণাও আগ্রহ তৈরি করতে পারে।
অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নাল লেটার্সে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে ম্যারিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা দাবি করেছেন, কম্পিউটার মডেলের ওপর ভিত্তি করে তারা এ প্রমাণ পেয়েছেন। পরবর্তীতে ভয়েজার ২ নিয়েও গবেষণা করবেন তাঁরা।
নাসার গবেষকেরা চলতি বছরের জুন মাসে জানিয়েছিলেন, মহাকাশের রহস্যের জাল ভেদ করতে এত দিন সৌরজগতের অভ্যন্তরেই ছিল মহাকাশ বিজ্ঞানীদের পদচারণ। সৌরজগতের প্রান্তসীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে ৩৫ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান নাসার উৎক্ষেপণ করা নভোযান ভয়েজার ১। ঠিক কবে নাগাদ ভয়েজার সৌরজগতের সীমা ছাড়াবে তা নির্দিষ্ট করে বলতে না পারলেও গবেষক এড স্টোন ওই সময় জানিয়েছিলেন, সেই মাহেন্দ্রক্ষণ খুব নিকটেই। এখন সৌরজগতের এক প্রান্তসীমায় অবস্থান করছে ভয়েজার ১।
Ispahani Tea
‘সায়েন্স’ সাময়িকীতে প্রকাশিত নিবন্ধে বলা হয়েছিল যে, বর্তমানে পৃথিবী থেকে সাড়ে ১৮ বিলিয়ন কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থান করছে এ নভোযানটি।

এর আগে ২০১২ সালে এজ স্টোন জানিয়েছিলেন, মহাকাশযানটি সৌরজগতের শেষ সীমায় অবস্থান করছে। সে সময় চার্জিত কণার একটি বিশেষ অঞ্চলে ভয়েজার ১ অবস্থান করছে বলে তিনি জানিয়েছিলেন। সে সময় তিনি বলেছিলেন, সূর্য-নিঃসৃত কণিকার প্রবাহ বর্হিমুখী না হয়ে বরং পার্শ্বমুখী হচ্ছে। এর মাধ্যমে বোঝা যায়, ভয়েজার ১ নক্ষত্র রাজির মধ্যকার মহাশূন্যের প্রায় কাছাকাছি অবস্থান করছে। সম্প্রতি গবেষক জানিয়েছেন, বিশেষ এ অঞ্চলটি পার হয়ে আরেকটি হালকা কণার বিশেষ স্তরে প্রবেশ করেছে ভয়েজার ১। এ অঞ্চলটি বিশেষ চৌম্বক স্তরের। গবেষকেরা ধারণা করছেন, এ বিশেষ স্তরটিই হচ্ছে সৌরমণ্ডলের সবচেয়ে বাইরের স্তর। তবে এই অঞ্চলটির বিস্তৃতি সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই তাঁদের। 
১৯৭৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ভয়েজার ১ পৃথিবী থেকে উৎক্ষেপণ করা হয়। ৩৫ বছর ধরে সৌরজগতের অজানা রহস্যের সন্ধান দিয়ে যাচ্ছে মহাকাশযানটি। গবেষকেরা বলছেন, সৌরজগতের মায়া কাটিয়ে ভয়েজার মহাশূন্যের এমন এক জায়গায় পৌঁছেছে যেখান থেকে পাঠানো তথ্য পৃথিবীতে আসতে সময় লাগছে ১৭ ঘণ্টা।
মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থার (নাসা) নভোযান ভয়েজার ১ সৌরজগতের এমন একটি অংশে প্রবেশ করেছে, যা গবেষকেদের কাছেও অজানা। এখানে নভোযানটির ওপর সূর্যের প্রভাবের চেয়ে মহাজাগতিক অন্য প্রভাব বেশি কাজ করছে। 

গবেষকেরা ধারণা করছেন, এ নভোযানটি ২০২০ সাল পর্যন্ত সংকেত পাঠাতে সক্ষম হবে। এরপর তা অজানার পথে পাড়ি দেবে। ধারণা করা হচ্ছে, এসি+৭৯৩৮৮ নামক নক্ষত্রের দিকে ছুটতে থাকবে এ নভোযানটি। কোনো দুর্ঘটনা ছাড়া ৪০ হাজার বছরের পথ পাড়ি দিয়ে দুই আলোকবর্ষ দূরের এ নক্ষত্রটির দিকে ছুটে যাবে মানুষের তৈরি এ নভোযান।

দশ–মাত্রিক মহাবিশ্ব ও সুপার স্ট্রিং তত্ত্ব

থিওডর কালুজাথিওডর কালুজাআজ থকে প্রায় ১০০ বছর আগে থিওডর কালুজা নামের এক তাত্ত্বিক পদার্থবিদ তাঁর একটা গবেষণাপত্র পাঠান পদার্থবিজ্ঞানের গ্র্যান্ডমাস্টার আলবার্ট আইনস্টাইনের কাছ। গবেষণাপত্রের আইডিয়াটা খুবই অদ্ভুত। কালুজা দেখাতে চেয়েছেন, আমাদের মহাবিশ্ব ৪ মাত্রার (দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা ও সময়) না হয়ে যদি ৫ মাত্রার হয়, তাহলে প্রকৃতির দুটি ভিন্ন ভিন্ন ইন্টারঅ্যাকশন বা বলকে একই গাণিতিক কাঠামোর ভেতর আনা সম্ভব। শোনা যায়, আইডিয়াটা আইনস্টাইনের খুবই পছন্দ হয়েছিল। তবে এটাকে আদৌ আমাদের প্রকৃতির গাণিতিক রূপ হিসেবে ব্যবহার করার কোনো যৌক্তিকতা তিনি খুঁজে পাননি, কারণ আমাদের জগৎ ৪ মাত্রার। বহু বছর পর স্ট্রিং তত্ত্ব আইডিয়াটা সাদরে গ্রহণ করে। শুধু তা-ই না, এই তত্ত্ব দাবি করে বসে, আমাদের এই মহাবিশ্ব আসলে ১০ মাত্রার। স্ট্রিং তত্ত্বের এই ১০–মাত্রিক মহাবিশ্বের ধারণাতে একটু পরে আসছি।

শুরুতেই কালুজার ওই আইডিয়া আরেকটু ব্যাখ্যা করা যাক। সহজ করে বোঝার জন্য একটা বই নেওয়া যেতে পারে, যার দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা এই তিনটি মাত্রা আছ। আর বইয়ের পৃষ্ঠাগুলোকে ধরা যেতে পারে দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থ এই ২ মাত্রার বস্তু, যা ৩ মাত্রার বইয়ের মধ্যে ঢোকানো। ব্যাপারটাকে এভাবে চিন্তা করা যতে পারে—একটা ৩ মাত্রার জগতে ২ মাত্রার জগৎ ঢোকানো আছে। একইভাবে একটা ৫ মাত্রার মহাবিশ্বের ভেতর ৪ মাত্রার বিশ্ব ঢোকানো আছে, কল্পনা করা যেতে পারে। এ রকমই একটা ৪ মাত্রার বিশ্বকে ধরা যতে পারে আমাদের এই জগৎ। প্রশ্ন হলো, অতিরিক্ত মাত্রা আমরা কেন ধরছি? মাত্রা বাড়ানোর সুবিধাটা হলো, যদি ৫ মাত্রার মহাবিশ্বে শুধু মহাকর্ষীয় বলের অস্তিত্ব আছে ধরা হয়, তবে এর মধ্যকার ৪ মাত্রার বিশ্ব শুধু মহাকর্ষীয় বল না, একটা বাড়তি তড়িৎ চুম্বকীয় বলের উপস্থিতি দেখতে পাবে। অর্থাৎ স্থানের মাত্রা কম হলে একই ইন্টারঅ্যাকশন ভিন্ন ভিন্ন ইন্টারঅ্যাকশন হয়ে ধরা দেয়। ঘুরিয়ে বললে স্থানের মাত্রা বাড়ালে আপাত ভিন্ন ইন্টারঅ্যাকশনগুলো এক হয়ে যায়। আইনস্টাইন নিঃসন্দেহে চিন্তার ক্ষেত্রে তাঁর সমসাময়িক সময়কে অতিক্রম করে গেছেন। কিন্তু দুঃখজনক হলো, এই আইডিয়া সৌন্দর্য ও সম্ভাবনা অনুধাবন করলেও বিষয়টা নিয়ে অগ্রসর হওয়ার মতো তথ্য-উপাত্ত বা জ্ঞান কোনোটিই তখনকার পদার্থবিজ্ঞান তাঁকে সরবরাহ করতে পারেনি। কাজেই এই অদ্ভুত সুন্দর আইডিয়াটা বিকশিত হতে পারেনি।
তবে স্ট্রিং তত্ত্বের কল্যাণে মৃত্যুর প্রায় ৫০ বছর পর আজ কালুজা তাঁর এই আজব প্রস্তাবের জন্য ভুবনবিখ্যাত। কালুজা ব্যক্তিজীবনে খুবই অদ্ভুত ধরনের একজন মানুষ ছিলেন। বলা হয়ে থাকে, তিনি নাকি ১৭টি ভাষা জানতেন। তাঁর সম্পর্কে আর একটি মজার তথ্য হলো, তিনি ৩০ বছর বয়সে কারও সাহায্য ছাড়া সম্পূর্ণ নিজে সাঁতার শিখেছিলেন। তিনি বই পড়ে জেনে নেন সাঁতারের কলাকৌশল, তারপর পানিতে নেমে প্রথম চেষ্টাতেই সফল হন।
Ispahani Tea
এই ধারাবাহিক লেখায় আমরা বলতে চেষ্টা করছি, পদার্থবিজ্ঞান বিভিন্ন বিষয়, তত্ত্ব এবং ধারণাকে একীভূতকরণ করতে চায় এবং পদার্থবিজ্ঞানের নানা বৈপ্লবিক উন্নতি এই একীভূতকরণ প্রচেষ্টার মাধ্যমে হয়েছে। একটা সহজ উদাহরণ দিয়ে একীভূতকরণের গুরুত্বটা আরেকবার বলার চেষ্টা করি। নিউটন যখন গাছ থেকে আপেল মাটিতে পড়তে দেখেন, তখন তিনি ভাবতে শুরু করলেন, আপেলের ওপর ভূমির আকর্ষণ বল এর গ্রহ-নক্ষত্রের মধ্যের আকর্ষণ বল একই ধরনের। লক্ষ করুন, এই একীভূত করার চিন্তাই কিন্তু জন্ম দিয়েছিল নিউটনের বিখ্যাত মহাকর্ষীয় বল তত্ত্বের। আরও লক্ষ করুন, এ ক্ষেত্রে একীভূতকরণটা কিন্তু কোনো ঐচ্ছিক ব্যাপার নয়, বাধ্যতামূলক। নিউটন আর তাঁর আপেলগাছের কথা যখন এলই, তখন এই বিষয়ে একটা ব্যক্তিগত গল্প বলা যতে পারে। আমি তখন কেবল পিএইচডি শুরু করেছি ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিন-ম্যাডিসনে। ওখানে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগসংলগ্ন বাগানে নিউটনের আপেলগাছের একটা গ্রাফটেড কপি আছে। সেই সময় আমাদের কিছু আত্মীয় বেড়াতে এলেন ম্যাডিসনে। একদিন তাঁদের আমরা ইউনিভার্সিটি ঘুরে দেখাচ্ছি। একপর্যায়ে ওই বাগানে গেলাম এবং নিউটনের আপেলগাছের ব্যাপারটা তাঁদের বললাম। হঠাৎ আমি কিছু বোঝার আগেই সবাই মিলে হুড়োহুড়ি করে গাছে যত আপেল ছিল তার একটা বড় অংশই পেড়ে ফেললেন। সেই মুহূর্তে ‘এদের চিনি না’—এ রকম ভঙ্গি করে একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখা ছাড়া আমার আর কিছু করার ছিল না।

উইসকনসিন ম্যাডিসনের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ-সংলগ্ন বাগানে নিউটনের আপেলগাছের গ্রাফটেড কপি।উইসকনসিন ম্যাডিসনের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগসংলগ্ন বাগানে নিউটনের আপেলগাছের গ্রাফটেড কপি।আগের লেখা দুটোতে বলা হয়েছে, স্ট্রিং তত্ত্বের একটা বড় সাফল্য হচ্ছে প্রকৃতির মৌলিক বলসমূহকে একীভূত করা। আজকের লেখায় বিষয়টা নিয়ে একটু আলোকপাত করা যাক। প্রকৃতিতে চার ধরনের মৌলিক বল বা ইন্টারঅ্যাকশন আছে। এই বলগুলো হলো মহাকর্ষীয় বল, তড়িৎ চুম্বকীয় বল, দুর্বল বল ও শক্তিশালী বল। প্রথম দুটি আমরা সবাই চিনি। দুর্বল বল ‘বেটা ডিকে’ বলে একটা প্রক্রিয়া আছে, তার জন্য দায়ী। এই প্রক্রিয়াতে একটা নিউট্রন একটা প্রোটন, ইলেকট্রন ও একটা অ্যান্টি-নিউট্রনোতে পরিণত হয়। শক্তিশালী বল হচ্ছে সেই বল, যা নিউট্রন ও প্রোটনের ভেতরকার কোয়ার্কগুলোকে একসঙ্গে ধরে রাখে। পদার্থবিজ্ঞানের দৃঢ় বিশ্বাস হলো, এই ইন্টারঅ্যাকশনগুলো আসলে একই, আমরা দেখতে পাই ভিন্ন ভিন্নভাবে। কাজেই এদের একটা সাধারণ গাণিতিক কাঠামোর ভেতর আনা সম্ভব। স্ট্রিং তত্ত্বের আগে এই চারটা ইন্টারঅ্যাকশনের ভেতর তিনটাকে পদার্থবিজ্ঞান একীভূত করতে সক্ষম হয়। এই একীভূতকরণ তত্ত্বটা ‘ স্টান্ডার্ড মডেল’ নামে পরিচিত। চতুর্থ ইন্টারঅ্যাকশন, মহাকর্ষ বলকে একটা সাধারণ গাণিতিক কাঠামোর ভেতর আনা সম্ভব হচ্ছিল না। এই কাঠামোটা স্বয়ং আইনস্টাইন অনেক চেষ্টা করেও দাঁড় করাতে পারেননি। এই অসম্ভব জটিল কাজটি সম্ভব করেছে স্ট্রিং তত্ত্ব।
স্ট্রিং তত্ত্বের এতসব গাণিতিক সাফল্য একবারে জটিলতাবিহীন নয়। একটা বড় সমস্যা হলো, আমাদের মহাবিশ্ব যদি সত্যিই অতি ক্ষুদ্র এই স্ট্রিং দিয়ে গড়া হয়ে থাকে, তবে গাণিতিকভাবে দেখানো যায় মহাবিশ্ব কোনোভাবেই ৪ মাত্রার হওয়া সম্ভব না। এখানে ৪ মাত্রার ব্যাপারটা একটু ব্যাখ্যা করা যাক। পাঠক একটা বাক্সের কথা চিন্তা করুন। এর দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা এই তিনটি মাত্রা আছ। এগুলোকে বলা হয় ‘স্থান’ মাত্রা। আমাদের মহাবিশ্বকে একটা বিশাল বড় বাক্স হিসেবে কল্পনা করা যতে পারে, যেখানে এই তিনটা মাত্রা কার্যত অসীম পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। আগের লেখাতে বলা হয়েছে, আইনস্টাইন স্থান ও সময় এই দুটি ধারণাকে একীভূত করেন। কাজেই সময়কে যোগ করলে মাত্রা দাঁড়ায় মোট চারটিতে। আমাদের দৃশ্যমান জগৎ এবং আমরাসহ এই জগতের অন্তর্ভুক্ত সবকিছুই এই ৪ মাত্রার। কিন্তু স্ট্রিং তত্ত্ব বলছে ভিন্ন কথা। এই তত্ত্ব অনুযায়ী আমাদের জগৎ হতে হবে ১০ মাত্রার। তার মানে দৃশ্যমান ৪ মাত্রার বাইরেও আরও ছয়টা মাত্রা আছ। এখানে বলে রাখা ভালো, এই বাড়তি মাত্রাগুলো সবই স্থান-মাত্রা। এখন প্রশ্ন হলো, এই মাত্রাগুলো গেল কোথায়? এদের আমরা দেখতে পাই না কেন? এই প্রশ্নের একটা দ্রুত উত্তর হলো, এই মাত্রাগুলো বেড়ে অসীম না হয়ে আবার শুরুর বিন্দুতে ফিরে এসেছে, অনেকটা বৃত্তের মতো। এই ব্যাপারটাকে আমরা কম্প্যাক্টিফিকেশন বলে থাকি। অতিরিক্ত ৬ মাত্রা একটা ৬ মাত্রার বৃত্তাকার বল তৈরি করে এবং এই বৃত্তের ব্যাসার্ধ অতি অতি ক্ষুদ্র হওয়ায় এর সম্পর্কে কোনো ধারণাই আমাদের নেই। মজার বিষয় হলো এই কম্প্যাক্টিফিকেশনের ধারণাটা কিন্তু সেই কালুজার সময় থেকেই এসেছে। কালুজার একটা অতিরিক্ত মাত্রার ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য ক্লাইন বলে একজন পদার্থবিদ এই কম্প্যাক্টিফিকেশনের ধারণা দেন। এ জন্য সম্মিলিতভাবে তাঁদের তত্ত্বটিকে ‘কালুজা-ক্লাইন তত্ত্ব’ বলা হয়।
এখন এই অতিরিক্ত ৬-মাত্রার ধারণাটা আরেকটু পরিষ্কার করার জন্য একটা সহজ উদাহরণ দেওয়া যাক। সার্কাসে দড়ির ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার একটা খেলা দেখানো হয়। যে খেলোয়াড় এই খেলাটা দেখাচ্ছেন, তাঁর জন্য দড়ির সোজা পথ ছাড়া বিকল্প কোনো রাস্তা নেই। কাজেই বলা যতে পারে, তাঁর জগৎ এক মাত্রার। এখন এই দড়ির ওপরে বসে থাকা একটা পিঁপড়ার কথা যদি বলা হয়, তবে তার জন্য একটা বিকল্প পথ কিন্তু আছে। সেটা হচ্ছে দড়ির পরিধি বরাবর। লক্ষ করুন, দড়ির পরিধি খেলোয়াড়ের আকৃতির তুলনায় অনেক ক্ষুদ্র হওয়ায় এই বৃত্তাকার রাস্তাটা সম্পর্কে তাঁর আসলে কোনো ধারণা নেই। স্ট্রিং তত্ত্বের অতিরিক্ত ছয় মাত্রার ব্যাপারটা মোটামুটি এ রকমই।
মাত্রার এই জটিলতা ছাড়াও আরও সমস্যা আছ। একটি হলো সিমেট্রি নিয়ে জটিলতা। সংক্ষেপে সিমেট্রি হলো একটা অপারেশন, যা সম্পাদনা করার পর বস্তু বা পরিমাপকের কোনো পরিবর্তন হয় না। যেমন মানুষ তথা প্রাণিকুলের ভেতর ডান-বাম সিমেট্রি লক্ষণীয়। আমাদের শরীররে ডান আর বাম পাশ একই রকম। আবার গাছপালার জগতে যে সিমেট্রি বেশি দেখা যায়, সেটা হলো ঘূর্ণন সিমেট্রি। ধরা যাক চার পাপড়ির একটা ফুলকে আপনি তার ডাল ধরে ৯০ ডিগ্রি ঘোরালেন। সেটা দেখতে ঠিক একই রকম লাগবে। আমাদের প্রকৃতিতে এমন অনেকে ধরনের সিমেট্রি আছে, যা আমরা সহজেই বুঝতে পারি। আবার গণিত দিয়ে কিছু সিমেট্রির ধারণা আমরা পাই। যেমন সুপার সিমেট্রি বলে একটি বিশেষ ধরনের সিমেট্রি আছে, যা স্ট্রিং তত্ত্বের গাণিতিক ভিত্তির জন্য দরকার। সুপার সিমেট্রি বিষয়টাকে একটু ব্যাখ্যা করা যাক। প্রকৃতিতে যে কণাগুলো আমরা পাই, ‘স্পিন’ নামক একধরনের বিশেষ বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে, তাদের মূলত দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। এদের বলে ‘বোসন’এবং ‘ফারমিওন’। এখানে বলে রাখি, বোসন এসেছে বিখ্যাত বাঙালি পদার্থবিদ সত্যেন বোসের নাম থেকে। যা-ই হোক, সুপার সিমেট্রি বলে প্রতিটি বোসন কণার একটা ফারমিওনিক সঙ্গী থাকবে। একইভাবে প্রতিটি ফারমিওনিক কণার একটা বোসোনিক সঙ্গী থাকবে। আর সুপার সিমেট্রি থাকার জন্য স্ট্রিং তত্ত্বকে সুপার স্ট্রিং তত্ত্বও বলা হয়। কিন্তু সমস্যাটা হলো, এই সুপার সিমেট্রি আমরা প্রকৃতিতে দেখতে পাই না। ঠিক করে বললে, এখনো দেখতে পাইনি। তবে আশার কথা হলো, এই সুপার সিমেট্রি পরীক্ষাগারে প্রমাণ করতে হলে যে শক্তিতে পরীক্ষাটা সাজাতে হবে, বলা চলে তার খুব কাছে আমরা আছি। হয়তো অচিরেই আমরা শুনতে পাব সেই সুখবর। এখানে বলে নেওয়া ভালো, সুপার সিমেট্রি পরীক্ষাগারে পাওয়া গেলেই প্রমাণ হবে না যে স্ট্রিং তত্ত্বই আমাদের প্রকৃতির সঠিক বর্ণনা। এটা শুধু আমাদের আশ্বস্ত করবে যে আমরা সম্ভবত ঠিক পথেই আছি।
যেকোনো মহান তত্ত্বের কাছে আমাদের মূল প্রত্যাশা হলো তত্ত্বটা পদার্থবিজ্ঞানের বিদ্যমান বিষয়গুলোকে মৌলিক উপায়ে ব্যাখ্যা করবে এবং নতুন নতুন বিষয়ের ভবিষ্যদ্বাণী করবে। পদার্থবিজ্ঞান অনেকটা ওরাকলের মতো, তবে এই জ্ঞান গুপ্তবিদ্যা নয়। গণিতের ভাষা জানলে অনেকেই তা করতে পারে। পদার্থবিজ্ঞানের একালের গ্র্যান্ডমাস্টার এডওয়ার্ড উইটেন এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, পদার্থবিজ্ঞানের সঙ্গে ইতিহাসের অনেক মিল আছে—দুটোই অনেকটা কবিতার মতো। এতে এক্সাক্ট পুনরাবৃত্তি নেই, কিন্তু ছন্দ আছে, আছে অন্ত্যমিল। অর্থাৎ এর পুনরাবৃত্তি সার্বিক গঠনে, ঘটনার আবহে, প্রতি শব্দে বা পুরো বাক্যে নয়। এর ভাষা এবং এর গঠন আয়ত্ত করা এবং পদার্থবিজ্ঞান তথা প্রকৃতির এই পুনরাবৃত্তি ধরতে পারাই হলো স্ট্রিং তত্ত্বের মূল লক্ষ্য। উদ্দেশ্যটা বোঝা সহজ, আমরা জগৎকে বুঝতে চাই, এর গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে নির্ভুল অনুমান করতে চাই। আমরাই কিন্তু প্রথম নই, আফ্রিকান সাভানাতে বসে আদিম মানুষও সেটাই করতে চেয়েছিল।
ড. সাজিদ হক: শিক্ষক ও গবেষক, স্ট্রিং থিওরি অ্যান্ড কসমোলজি, ইউনিভার্সিটি অব উইন্ডসর, কানাডা
ই-মেইল: shajidhaque@gmail.com

লেখকের এ বিষয়ে আগের লেখা—
১. ‘থিওরি অব এভরিথিং’ 
২. প্রথম স্ট্রিং বিপ্লব 

প্রথম স্ট্রিং বিপ্লব

গ্যাব্রিয়েল ভেনেজিয়ানো, লিওনার্ড সাসকিন্ড, ইয়িচিরো নাম্বু। ছবি: সংগৃহীতগ্যাব্রিয়েল ভেনেজিয়ানো, লিওনার্ড সাসকিন্ড, ইয়িচিরো নাম্বু। ছবি: সংগৃহীতআশির দশকের শুরুর দিকে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর একটি হিসেবে স্ট্রিং তত্ত্ব নিজের জায়গা করে নেয়। ওই সময় প্রমাণিত হয়, স্ট্রিং তত্ত্ব গাণিতিকভাবে বিশুদ্ধ একটি তত্ত্ব এবং এ বিষয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে একটা জোয়ার আসে, যাকে পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে ‘প্রথম স্ট্রিং বিপ্লব’ বলা হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, শুরুর দিকে স্ট্রিং তত্ত্ব পদার্থবিদদের মনোযোগ ঠিক সেভাবে কাড়তে পারেনি। কিন্তু এই আশির দশক থেকেই মূলত স্ট্রিং তত্ত্ব তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার ক্ষেত্রে গবেষণার গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। আজকে এই স্ট্রিং বিপ্লবের সূত্রপাতের প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা করব।
আমি ইতিহাস বেশ পছন্দ করি, যদিও এই বিষয়টিতে আমার তেমন দক্ষতা নেই। সত্যি বলতে কি, পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাস আমাকে আনন্দ দেওয়ার পাশাপাশি বিষণ্নও করে। বিখ্যাত সব পদার্থবিদের নানা অর্জনের কথা পড়ে নিজেকে ক্ষুদ্র মনে হয়। আগের লেখাটিতে বলেছিলাম  স্ট্রিং তত্ত্ব তিনটা বিষয়কে একীভূত করে । এক, পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন তত্ত্ব; দুই, প্রকৃতির মৌলিক বলসমূহ; তিন, প্রকৃতির মৌলিক কণাসমূহ। এর মধ্যে মৌলিক কণার একীভূতকরণ নিয়ে গত লেখায় কিছুটা ব্যাখ্যা দিয়েছি। আজকে স্ট্রিং–এর জন্মকথা দিয়ে শুরু করা যাক। তারপর আলোচনা করব তত্ত্ব একীভূতকরণ বিষয়টা নিয়ে।
Ispahani Tea
১৯৬৮ সালে গ্যাব্রিয়েল ভেনেজিয়ানো নামের ইতালির একজন তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী ‘Strong Interaction’ (স্ট্রং ইন্টারঅ্যাকশন) বলে একটা বিষয় নিয়ে কাজ করছিলেন। ভেনেজিয়ানো ‘accelerator’ নামের একধরনের বৈজ্ঞানিক যন্ত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণ করছিলেন। তিনি খুবই কৌতূহলোদ্দীপক একটা বিষয় লক্ষ করেন। গণিতে ‘অয়লার বেটা ফাংশন’ বলে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা ফাংশন আছে। ভেনেজিয়ানো দেখলেন, চার–কণার scattering প্রক্রিয়ার অনেক বৈশিষ্ট্যকে এই অয়লার বেটা ফাংশন দিয়ে গাণিতিকভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। তবে এটা নিয়ে সেই সময় ভেনেজিয়ানো তেমন কোনো আলোকপাত করতে পারেননি। তিনি কল্পনাও করেননি কী দানবীয় একটা তত্ত্বের জন্ম হতে যাচ্ছে।

এরপর ১৯৭০ সালের দিকে মার্কিন পদার্থবিজ্ঞানী লিওনার্ড সাসকিন্ড, ড্যানিশ পদার্থবিজ্ঞানী হলগার নিয়েলসন ও জাপানি পদার্থবিজ্ঞানী ইয়িচিরো নাম্বু দেখান যে ভেনেজিয়ানোর দেওয়া গাণিতিক বর্ণনাটা আরও যথার্থ হয় যদি কণার বদলে স্ট্রিং কল্পনা করা হয়। বিষয়টাকে একটু সহজভাবে বলার চেষ্টা করি। ধরা যাক, দুটি কণা একটি আরেকটিকে প্রচণ্ড গতিতে ধাক্কা দিল, তারপর দুদিকে চলে গেল। এই প্রক্রিয়াকে বলা যেতে পারে চার-কণার scattering। এখানে চার-কণা বলছি এই কারণে যে ধাক্কার পরে কণাগুলোর বৈশিষ্ট্যে কিছু পরিবর্তন আসতে পারে। এখন দুটি কণার বদলে রাবার ব্যান্ডের মতো দুটি সুতা বা তন্তু (স্ট্রিং) চিন্তা করলে তাদের একে অপরকে ধাক্কা দেওয়ার ব্যাপারটা অনেকটাই অন্য রকম হয়ে যায়। স্বাভাবিকভাবেই এই দুই প্রক্রিয়াকে গাণিতিকভাবে প্রকাশ করলে তা-ও ভিন্ন হবে।
কণার scattering স্ট্রিং scattering থেকে ভিন্ন। ছবি: ড. সাজিদ হককণার scattering স্ট্রিং scattering থেকে ভিন্ন। ছবি: ড. সাজিদ হকমজার বিষয় হলো, সাসকিন্ডদের এই প্রস্তাব সে সময় কেউ অতটা গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি। এটাকে কেবলই একটা interesting পর্যবেক্ষণ হিসেবে দেখা হতো। আসলে পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণা ফ্যাশন দুনিয়ার মতোই ট্রেন্ডি। আর সেই সময় কণাতত্ত্বই ছিল আকর্ষণের কেন্দ্রে। কাজেই কয়েক বছরের মধ্যে এই ব্যাপারটা একরকম চাপা পড়ে গেল।
তবে ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (Caltech) তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী জন শোয়ার্জের বিশ্বাস ছিল, এই কণার পরিবর্তে স্ট্রিং নেওয়ার বিষয়টি বেশ সাহসী ধারণা এবং এটা একটি বড় তত্ত্বের ইঙ্গিতবাহী। তিনি ও তাঁর সহযোগী গবেষকেরা বিষয়টি নিয়ে ভাবতে থাকলেন এবং তাঁরাই একসময় এটাকে একটা তত্ত্ব হিসেবে দাঁড় করালেন। আরও পরিষ্কার করে বলা যায়, তাঁরা এই তত্ত্বকে মহাকর্ষীয় বলের একটা কোয়ান্টাম তত্ত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করলেন। পরে বিষয়টি নিয়ে আবার আসব।
দুঃখজনক বিষয় হলো, তারপরও স্ট্রিং তত্ত্ব পদার্থবিদদের মনোযোগ কাড়তে পারল না। মূল কারণ ছিল, তত্ত্বটিতে ‘Anomaly’ নামের একধরনের গাণিতিক সমস্যা ছিল। যা হোক, একপর্যায়ে ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী মাইকেল গ্রিন শোয়ার্জের সঙ্গে যোগ দিলেন। তাঁরা প্রায় ১০ বছর ধরে তত্ত্বের এই Anomalyগুলো দূর করার চেষ্টা করে ১৯৮৪ সালে এসে সফল হলেন। এই কাজ Green-Schwarz mechanism নামে পরিচিত। এর ফলে স্ট্রিং তত্ত্বের গবেষণার ধারা সম্পূর্ণরূপে বদলে গেল। আশির দশকে স্ট্রিং তত্ত্ব হয়ে দাঁড়াল পদার্থবিদ্যার সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয়গুলোর একটি। এই Green-Schwarz mechanism প্রথমবারের মতো স্ট্রিং তত্ত্বের গবেষণার ক্ষেত্রে একধরনের বিপ্লবের সূচনা করে, যা প্রথম স্ট্রিং বিপ্লব নামে পরিচিত।
যেহেতু মাইকেল গ্রিন এবং জন শোয়ার্জের প্রসঙ্গ এল, তাই এঁদের নিয়ে একটা গল্প বলার লোভ সামলাতে পারছি না। আমি যখন পিএইচডি করছিলাম, তখন স্ট্রিং তত্ত্ব নিয়ে বাজারে খুব বেশি পাঠ্যবই ছিল না। যে দু–একটা বই ছিল, তার ভেতর একটা ছিল মাইকেল গ্রিন, জন শোয়ার্জ ও এডওয়ার্ড উইটেনের লেখা। বইটার কভার পেজ সবুজ রঙের। বইটা নিয়ে একটা রসিকতা চালু আছে। বলা হয়, বইটার সবচেয়ে ভালো অংশগুলো এডওয়ার্ড উইটেনের লেখা। বাকি অংশ লেখা জন শোয়ার্জের। আর সবুজ (গ্রিন) কভার পেজটা মাইকেল গ্রিনের অবদান। পাঠকের জন্য জানাচ্ছি, এডওয়ার্ড উইটেন হচ্ছেন এই সময়ের সবচেয়ে বিখ্যাত ও অসাধারণ মেধাবী একজন পদার্থবিজ্ঞানী। উনিই Fields Medal পাওয়া একমাত্র পদার্থবিজ্ঞানী। Fields Medal হচ্ছে গণিতে অসাধারণ অবদানের জন্য দেওয়া সবচেয়ে বড় পুরস্কার। এটি নোবেল পুরস্কারের মতোই সম্মানজনক। নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে ‘দ্বিতীয় স্ট্রিং বিপ্লব’ এডওয়ার্ড উইটেনের হাত ধরেই আসে। এ বিষয়ে অন্য কোনো দিন বলব।
এখন আবার ফিরে আসি তত্ত্ব একীভূতকরণ প্রসঙ্গে। প্রায়শই তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের উন্নতি নির্ণয় করার জন্য তা ভিন্ন ভিন্ন তত্ত্বকে একীভূত করতে পারছে কি না, তা একটা বড় সূচক হিসেবে কাজ করে। একটা সহজ উদাহরণ দিয়ে শুরু করা যাক। বহু বছর ধরে বিদ্যুৎ ও চৌম্বকত্বকে সম্পর্কহীন ভিন্ন ভিন্ন বিষয় হিসেবে দেখা হতো। পরে ১৮৬৫ সালে জেমস ক্লার্ক মাক্সওয়েল নামের একজন স্কটিশ পদার্থবিদ চারটি অতি সাধারণ কিন্তু নান্দনিক সমীকরণ দিয়ে এই বিষয়ে আমাদের চিন্তাধারা সম্পূর্ণ বদলে দিলেন। তিনি এই দুটি আপাতভিন্ন বিষয়কে একটা সাধারণ গাণিতিক কাঠামোর ভেতর নিয়ে এলেন। তা ছাড়া এই সমীকরণগুলো তড়িৎচৌম্বকীয় তরঙ্গ সম্পর্কেও পরিষ্কার ধারণা দেয়। এখানে একটা বিষয় বলে নেওয়া ভালো, এই বিদ্যুৎ ও চৌম্বকত্বকে একীভূতকরণ তথা মাক্সওয়েলের সমীকরণগুলো কিন্তু কোনো ঐচ্ছিক ব্যাপার নয়। এটা ছাড়া বিদ্যুৎ ও চৌম্বকত্বের ধারণাটাই অসামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।
মাইকেল গ্রিন, জন শোয়ার্জ ও এডওয়ার্ড উইটেন। ছবি: সংগৃহীতমাইকেল গ্রিন, জন শোয়ার্জ ও এডওয়ার্ড উইটেন। ছবি: সংগৃহীতএর প্রায় চল্লিশ বছর পর পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে মানুষের চিন্তার ক্ষেত্রে আরেকটা যুগান্তকারী পরিবর্তন (change of paradigm) সূচিত হয়। এটাও আসে একধরনের একীভূতকরণের চেষ্টা থেকে। আইনস্টাইন নামের মাত্র ২৬ বছরের এক পেটেন্ট অফিসের কেরানি ‘স্থান’ ও ‘কাল’ মূলত একই—এটা বলে পদার্থবিদদের একেবারে চমকে দিলেন। এখানে লক্ষ করার বিষয় হলো, আইনস্টাইন বয়সে তরুণ ছিলেন তা ঠিক, কিন্তু তিনি ক্র্যাক পট তা ছিলেন না। তাঁর আন্ডার গ্র্যাজুয়েট পড়াশোনার বিষয়ই ছিল পদার্থবিজ্ঞান। এরও প্রায় ১০ বছর পরে ১৯১৬ সালে আইনস্টাইন আপেক্ষিকতাবাদের ধারণাকে একটি বিশেষ ক্ষেত্র থেকে সাধারণ তত্ত্বে (General theory of Relativity) পরিণত করেন। সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ নিঃসন্দেহে পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে আলোচিত তত্ত্ব। এর আবিষ্কারক হিসেবে আইনস্টাইন পেয়ে যান রকস্টারদের মতো খ্যাতি।
প্রকৃতির নিয়মগুলো বুঝতে উক্ত তত্ত্বগুলো আমাদের চিন্তার ক্ষেত্রে অসাধারণ পরিবর্তন আনে। এরই ধারাবাহিকতায় গত শতকের প্রথম দুই-তিন দশকে পদার্থবিজ্ঞানের জগতে আরেকটা খুব বড় ওলট–পালট হয় কোয়ান্টাম বলবিদ্যার হাত ধরে। কোয়ান্টাম বলবিদ্যা হলো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জগতের পদার্থবিদ্যা। কোয়ান্টাম বলবিদ্যাকে অনেক সময় তত্ত্ব না বলে বলা হয় ‘চিন্তাকাঠামো’। এটা মূলত কিছু নিয়মের অবতারণা করে, যে নিয়ম মেনে তত্ত্বগুলোকে ব্যবহার করা হয়। উদ্দেশ্য হলো এর থেকে physical prediction করা। মজার ব্যাপার হলো, কোয়ান্টাম বলবিদ্যা এবং আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ (যাকে মহাকর্ষীয় বলের তত্ত্ব বলা হয়) এই দুটি অতি বিখ্যাত তত্ত্ব একটি আরেকটিকে একদমই পছন্দ করে না। আর সেই জন্যই প্রয়োজন পড়ে স্ট্রিং তত্ত্বের। এখানে লক্ষণীয়, এই সমস্যাটা কিন্তু তড়িৎ চুম্বকীয় বলের কোয়ান্টাম তত্ত্বের ক্ষেত্রে হয় না, বা বলা ভালো সমস্যাটা ততটা প্রকট না। সে ক্ষেত্রে আমরা Photon-কণা পাই, কিন্তু মহাকর্ষ বলের জন্য Graviton-কণা পাওয়া যায় না।
এই অতি জটিল গাণিতিক সমস্যাটা সমাধানে আমাদের দরকার হয় স্ট্রিং তত্ত্বের। স্ট্রিং তত্ত্ব সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ (মহাকর্ষীয় বলের তত্ত্ব) এবং কোয়ান্টাম বলবিদ্যা এই দুটি পরস্পরবিরোধী বিষয়কে একীভূত করে। একটু ব্যাখ্যা করা যাক, সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ একটা ক্ল্যাসিক্যাল তত্ত্ব এবং এই তত্ত্বের কোয়ান্টাম রূপ দেওয়া অসম্ভব কঠিন একটা ব্যাপার। বলা ভালো, এরা একে ওপরের জন্য ঠিক তৈরি না। কিন্তু সমস্যা হলো মহাকর্ষীয় বলের কোয়ান্টাম তত্ত্ব আমাদের দরকার, এটা কোনো ঐচ্ছিক বিষয় নয়। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একদম শুরুর অবস্থা অথবা কৃষ্ণ বিবরের (Black Hole) ভেতরে কী হচ্ছে, তা জানার জন্য অন্য কোনো উপায় নেই। ধরা যাক কেউ একজন বোকার মতো কৃষ্ণ বিবরের ভেতরে লাফ দিল। এখন সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের কোয়ান্টাম তত্ত্ব ব্যতীত বলা সম্ভব নয়, তার ভাগ্যে কী ঘটবে। আর আমরা যদি সাবধানতা অবলম্বন করি, কখনো কৃষ্ণ বিবরের ধারে–কাছে না যাই, তাহলে এই তথ্য আমাদের কাছে অধরাই থেকে যাবে। কেন যেন প্রকৃতি আমাদের কাছ থেকে এই ব্যাপারটা লুকিয়ে রাখতে চায়। গত লেখাতেই প্ল্যাঙ্ক স্কেল সম্পর্কে বলা হয়েছে। ব্ল্যাক হোলের রহস্য জানতে হলে এই প্ল্যাঙ্ক স্কেলে প্রকৃতি কোন সূত্র বা নিয়ম মেনে চলে, তা আমাদের জানতে হবে। আর সেই সূত্র হতে হবে মহাকর্ষীয় বলের কোয়ান্টাম তত্ত্ব। স্ট্রিং তত্ত্ব হচ্ছে এমনই একটা তত্ত্ব।

ড. সাজিদ হক: শিক্ষক ও গবেষক, স্ট্রিং থিওরি অ্যান্ড কসমোলজি, ইউনিভার্সিটি অব উইন্ডসর, কানাডা
ই-মেইল: shajidhaque@gmail.com

‘থিওরি অব এভরিথিং’

সহজ ভাষায় বলতে হয় স্ট্রিং তত্ত্ব হচ্ছে সবকিছুর তত্ত্ব। বিবৃতিটাকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিভ্রান্তিকর বলেন বিজ্ঞানীরা। ছবি: সংগৃহীতসহজ ভাষায় বলতে হয় স্ট্রিং তত্ত্ব হচ্ছে সবকিছুর তত্ত্ব। বিবৃতিটাকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিভ্রান্তিকর বলেন বিজ্ঞানীরা। ছবি: সংগৃহীতপপুলার কালচারে একটা কথা প্রচলিত আছে যে ‘স্ট্রিং থিওরি ইজ দ্য থিওরি অব এভরিথিং’। অর্থাৎ সহজ ভাষায় বলতে হয়, স্ট্রিং তত্ত্ব হচ্ছে সবকিছুর তত্ত্ব। তবে এই বিবৃতি আমার সব সময় বিভ্রান্তিকর বলে মনে হয়। কেন? সেটা ব্যাখ্যা করা যাক।
আমার পাঁচ বছর বয়সী মেয়ে ডাইনোসরের মহাভক্ত। একদিন সে আমার কাছে এল ডাইনোসর-বিষয়ক একটা বই হাতে নিয়ে। সেখান থেকে সে আমাকে একটা বিশেষ ডাইনোসরের ছবি দেখাল, যার নাকে একটা গোলাপি রঙের শুণ্ড (Snout) আছে। সে আমার কাছে জানতে চাইল, এটা কেন আছে? পাঠক নিশ্চয় অনুমান করতে পারছেন আমার থিওরি অব এভরিথিংয়ের জ্ঞান সেদিন তেমন কোনো কাজে আসেনি। তবে আমি বাচ্চাদের সঙ্গে যতটা সম্ভব সৎ থাকার চেষ্টা করি। তাই আমি ওকে কোনো মনগড়া কাল্পনিক উত্তর দিইনি। শুধু বলেছিলাম, আমি জানি না। সে এরপর চলে গেল তার মায়ের কাছে এবং প্রশ্নের বিভিন্ন ধরনের উত্তর পেল। তবে কোনো উত্তরই তার পছন্দ হলো না। শেষমেশ সে নিজে ভেবে একটা উত্তর দাঁড় করাল। ‘এই প্রজাতির ডাইনোসররা ফুল খুব পছন্দ করে। যেহেতু বেশির ভাগ ফুলই গোলাপি রঙের হয়, তাই এই ডাইনোসরদের গোলাপি রঙের শুণ্ড আছে।’
Ispahani Tea
এই যুক্তি আমার মেয়ের নিজের কাছেই খুব যুক্তিসংগত বলে মনে হলো। কাজেই পাঠক নিশ্চয় অনুধাবন করতে পারছেন, স্ট্রিং তত্ত্বকে কেন আমি থিওরি অব এভরিথিং বলতে চাই না।

স্ট্রিং থিওরি বলে আমাদের প্রকৃতির মৌলিক বিল্ডিং ব্লক হলো এক মাত্রার সুতা বা তন্তুর মতো বস্তু, যার দৈর্ঘ্য প্ল্যাঙ্কের দৈর্ঘ্যের কাছাকাছি। ছবি: সংগৃহীতস্ট্রিং থিওরি বলে আমাদের প্রকৃতির মৌলিক বিল্ডিং ব্লক হলো এক মাত্রার সুতা বা তন্তুর মতো বস্তু, যার দৈর্ঘ্য প্ল্যাঙ্কের দৈর্ঘ্যের কাছাকাছি। ছবি: সংগৃহীতআসলে এই বিভ্রান্তি সম্ভবত তৈরি হয়েছে আইনস্টাইনের শেষ দিকের গবেষণাকে কেন্দ্র করে। আইনস্টাইন চেষ্টা করেছিলেন পদার্থবিজ্ঞানের একটা সম্মিলিত তত্ত্ব দাঁড় করাতে। প্রশ্ন হলো, এই সম্মিলিত তত্ত্ব বলতে ঠিক কী বোঝায়? সহজ ভাষায় সম্মিলিত তত্ত্ব হলো সেই তত্ত্ব, যা অন্য অনেক খণ্ড খণ্ড তত্ত্ব বা ধারণাকে একটি তত্ত্বে একীভূত করতে পারে। পদার্থবিজ্ঞানের একটি সম্মিলিত তত্ত্ব বের করার যে প্রচেষ্টা, তার সর্বাধুনিক এবং সবচেয়ে সফল ফলাফল বলা যেতে পারে স্ট্রিং তত্ত্বকে।
স্ট্রিং তত্ত্ব মূলত তিনটি বিষয়কে একীভূত করতে চায়। এক. পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন তত্ত্ব; দুই. প্রকৃতির মৌলিক বলসমূহ এবং তিন. প্রকৃতির মৌলিক কণাসমূহ।
আমি আজ তিন নম্বর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে চাইছি। কারণ, বিষয়টি স্ট্রিং তত্ত্বের কেন্দ্রীয় ভাবনা নিয়ে আলোকপাত করে। এ ছাড়া এটাই সম্ভবত স্ট্রিং তত্ত্বের জন্ম নিয়ে কথা বলার জন্য আদর্শ জায়গা।
ড. সাজিদ হকড. সাজিদ হকপদার্থবিজ্ঞান রিডাকশনাজম (খণ্ডতাবাদ) ব্যবহার করে। আমি এখানে প্রক্রিয়াগত খণ্ডতাবাদের কথা বলছি। মূল কথা, একটা বস্তুকে ভাঙতে থাকলে আমরা একসময় বিন্দুর মতো কণা পাব। কণাতত্ত্ব অনুযায়ী আমাদের প্রকৃতির মৌলিক বিল্ডিং ব্লক হচ্ছে এই কণা। লক্ষ করার বিষয় হলো এ ক্ষেত্রে আমরা একটা আদর্শীকরণ করি। এই কণাগুলোকে ধরি বিন্দুর মতো যার কোনো ‘মাত্রা’ নেই, শুধু ভর আছে। এখন ধরা যাক, একটা বিন্দু কণা সৃষ্ট মহাকর্ষীয় প্রভাব বলয়ের (পটেনশিয়াল) কথা, যা কিনা দূরত্বের প্রতি-সমানুপাতিক। এখান থেকে খুব দ্রুতই আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে দূরত্ব যখন শূন্য হয়ে যায়, তখন এই পরিমাপকটা অসীম হয়ে যায়। পদার্থবিজ্ঞান অসীম পছন্দ করে না। পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অসীম পাওয়ার অর্থ হচ্ছে এ ক্ষেত্রে ঠিক কী হচ্ছে, পদার্থবিজ্ঞান তা বুঝতে পারছে না।
তাহলে প্রশ্ন হলো এটা কি প্রমাণ করে যে সমীকরণটা ভুল? ঠিক তা না আসলে।
আরও গোড়া থেকে শুরু করা যাক। পদার্থবিজ্ঞানে আসলে আমরা কী করি? গণিত ব্যবহার করে আমরা কতগুলো পরিমাপক সংজ্ঞায়িত করি, যাদের কিছু গাণিতিক আর কিছু ভৌত। ভৌত পরিমাপকগুলো আমরা পরীক্ষাগারে মাপতে পারি। যখন আমরা পরিমাপ করি, তখন এটা জানা আবশ্যক যে পরিমাপের স্কেলটা কী। ম্যাকক্রোসকপিক ইভেন্টে আমরা আসলে মাইক্রোসকপিক্যালি পরিমাপকের সংজ্ঞাটা ব্যর্থ হলো কি না, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করি না। কিন্তু দিন শেষে এটা একটা প্র্যাকটিক্যাল স্ট্যান্ড পয়েন্ট। ধরা যাক, আমরা আসলে জানতে চাই মাইক্রোসকপিক্যালি কী হচ্ছে? লক্ষ করুন যে ‘অসীম’টা আমরা পাচ্ছি, তা আসলে কণাকে বিন্দুর মতো চিন্তা করার জন্য হচ্ছে। এই সমস্যা থেকে বের হতে হলে আমাদের ধরে নিতে হবে, প্রকৃতির একটা সর্বনিম্ন দৈর্ঘ্য আছে। এটাকে আমরা প্ল্যাঙ্ক দৈর্ঘ্য বলি। এটি ১০ টু দ্য পাওয়ার-৩৩ সেন্টিমিটার (দশমিকের পর ৩২টা শূন্য তারপর এক) বা শক্তি এককে ১০ টু দ্য পাওয়ার ১৯ জিইভির (গিগা ইলেকট্রন ভোল্ট) সমান। এখানেই স্ট্রিং থিওরির ব্যুৎপত্তি। স্ট্রিং থিওরি বলে আমাদের প্রকৃতির মৌলিক বিল্ডিং ব্লক হলো এক মাত্রার সুতা বা তন্তুর মতো বস্তু, যার দৈর্ঘ্য প্ল্যাঙ্কের দৈর্ঘ্যের কাছাকাছি।
প্রকৃতির মৌলিক বিল্ডিং ব্লক হচ্ছে শুধুই এক ধরনের অতি ক্ষুদ্র তন্তু (স্ট্রিং)। এই তন্তুর বিভিন্ন ধরনের কম্পনের ফলে ভিন্ন ভিন্ন কণার উৎপত্তি হয়। ছবি: সংগৃহীতপ্রকৃতির মৌলিক বিল্ডিং ব্লক হচ্ছে শুধুই এক ধরনের অতি ক্ষুদ্র তন্তু (স্ট্রিং)। এই তন্তুর বিভিন্ন ধরনের কম্পনের ফলে ভিন্ন ভিন্ন কণার উৎপত্তি হয়। ছবি: সংগৃহীতকণাতত্ত্ব (আরও নির্দিষ্ট করে বললে স্টান্ডার্ড মডেল) থেকে আমরা দেখতে পাই, প্রকৃতিতে ৬০ টির মতো মৌলিক কণা আছে। এই সংখ্যা ‘কণা’কে আমাদের প্রাকৃতিক মৌলিক বিল্ডিং ব্লক দাবি করার জন্য বেশ বড়। মোদ্দা কথা হলো, যা মৌলিক তার সংখ্যা কম হওয়ায় যুক্তিযুক্ত। এই কণার চিড়িয়াখানা মৌলিক বিল্ডিং ব্লক ধারণার পরিপন্থী। ঠিক এই ব্যাপারে স্ট্রিং তত্ত্ব এগিয়ে আসে।
এই তত্ত্ব অনুযায়ী আমাদের প্রকৃতির মৌলিক বিল্ডিং ব্লক হচ্ছে শুধুই একধরনের অতি ক্ষুদ্র তন্তু (স্ট্রিং), আর কিছু না। এই তন্তুর বিভিন্ন ধরনের কম্পনের ফলে ভিন্ন ভিন্ন কণার উৎপত্তি হয়। এভাবেই স্ট্রিং সব কণাকে এক মালায় গাঁথে। আগেই বলা হয়েছে, এই স্ট্রিং খুবই ছোট (১০ টু দ্য পাওয়ার-৩২ বা শক্তি এককে ১০ টু দ্য পাওয়ার ১৪ গিগা ইলেকট্রন ভোল্ট)। পাঠকের সুবিধার্থে এই সংখ্যাগুলো সম্পর্কে একটু অন্যভাবে ধারণা দেওয়া যাক। আমরা সবাই আমাদের সৌরজগৎ সম্পর্কে জানি। আমাদের সৌরজগতের দৈর্ঘ্য (ব্যাস) কী হতে পারে, তার একটা ধারণা আমরা পাই পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব চিন্তা করলে। এখন এ ধরনের বিলিয়ন বিলিয়ন সৌরজগৎ মিলে একটা গ্যালাক্সি হয়। কাজেই তাঁর দৈর্ঘ্য কী হতে পারে, তা কল্পনা করাও কঠিন। এখন এ রকম প্রায় এক বিলিয়ন গ্যালাক্সির দৈর্ঘ্য আমাদের হাতের নখের দৈর্ঘ্যের তুলনায় যে রকম বড়, হাতের নখটা একটা স্ট্রিংয়ের তুলনায় সে রকমই বড়। কাজেই পর্যবেক্ষণ করার কোনো প্রশ্নই আপাতত আসে না।

ড. সাজিদ হক: শিক্ষক ও গবেষক, স্ট্রিং থিওরি অ্যান্ড কসমোলজি, ইউনিভার্সিটি অব উইন্ডসর, কানাডা
ই-মেইল: shajidhaque@gmail.com

FSS blog

FSS TSTL Photo Gallery

FSS TSTL Photo Gallery
Pictures

I like it

  • Bangla Song
  • Love
  • Move

what is love?

এই ব্লগটি সন্ধান করুন

লেবেল

লেবেল

ভূমি (1) sex (6)

Wikipedia

সার্চ ফলাফল