দি সুপারসনিক ম্যান: ফেলিক্স বমগার্টনার
ইতিহাসের পাতায় নাম লেখালেন অস্ট্রিয়ান ‘ডেয়ারডেভিল’ ফেলিক্স বমগার্টনার। ১৪ অক্টোবর মাটি থেকে ১ লাখ ২৮ হাজার ১০০ ফিট উপরের একটি স্পেস ক্যাপসুল থেকে পৃথিবীর উদ্দেশ্যে লাফিয়ে পড়েন বমগার্টনার। পতনের গতি ছাড়িয়ে যায় ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৮৩৩.৯ মাইল। শব্দের চেয়েও দ্রুতগতিতে পতনের পর প্যারাসুটের সাহায্যে মাটিতে নামেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মেক্সিকোর রসওয়েলে। সবচেয়ে উচ্চতম স্কাইডাইভিংয়ে আগের রেকর্ডটি ভেঙে গড়েন নতুন রেকর্ড। সাউন্ড ব্যারিয়ার ভেঙে ইতিহাসের পাতায় নাম লেখান বিশ্বের প্রথম সুপারসনিক ম্যান হিসেবে। খবর বিবিসির।ইতিহাস গড়া স্কাইডাইভিংয়ের জন্য বমগার্টনারকে পেরিয়ে আসতে হয়েছে অনেক বাধা বিপত্তি। প্রশিক্ষণ নিয়েছেন দীর্ঘদিন। প্রথমে স্কাইডাইভিংয়ের দিন স্থির করা হয়েছিলো ৮ অক্টোবর। খারাপ আবহাওয়ার কারণে বারবার পিছিয়ে যায় বহু প্রতীক্ষিত দিনটি। শেষে ১৪ অক্টোবর জীবনের ঝুঁকি ভুলে ঝাঁপিয়ে পড়েন মহাশূন্যে। পৃথিবীর মাটিতে পা দিয়ে গড়েন ইতিহাস।
কিন্তু আরেকটু হলেই শেষ মুহুর্তে বমগার্টনারকে বাতিল করতে হতো স্কাইডাইভ। কাজ করছিলো না তার স্পেস স্যুটটির হিটার। ফলে প্রতিবার নিশ্বাস ফেললেই ঘোলা হয়ে যাচ্ছিলো ভাইজরটি।
স্পেস ক্যাপসুল থেকে লাফ দেবার পর বমগার্টনার মাটিতে নেমে আসেন ৯ মিনিট ৩ সেকেন্ডে। একেবারে মাটির কাছাকাছি এসেই খুলে দেন নিজের প্যারাসুট। অবতরণের পর হাঁটু গেড়ে বসে পড়েন মাটিতে, হাত দুটো আকাশ পানে ছুঁড়ে করেন বিজয় উল্লাস। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে অভিনন্দন জানাতে সেখানে পৌঁছে যায় রিকভারি হেলিকপ্টার।
এর পরপরই এক প্রেস কনফারেন্সে নিজের অনুভূতি জানিয়ে বমগার্টনার বলেন, ‘আমি যখন পৃথিবীর উপরে স্পেস ক্যাপসুলটিতে দাঁড়িয়ে ছিলাম, নিজেকে অনেক ক্ষুদ্র মনে হচ্ছিলো তখন। ভুলে গিয়েছিলাম বিশ্ব রেকর্ড ভাঙার কথা। কেবল জীবন্ত পৃথিবীর বুকে ফিরে আসার কথাই ভাবছিলাম বারবার।’
শুরুতেই নিজের রেড বুল স্ট্র্যাটোস টিমের সদস্য আর দর্শক, সাংবাদিকদের দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলেন বমগার্টনার। পতনের শুরুতে মাথা নিচে, দু’ হাত ছড়িয়ে দিয়ে তার থাকার কথা ছিলো ডেল্টা পজিশনে। কিন্তু লাফিয়ে পড়ার পরই বায়ুমণ্ডলে বারবার ঘুরপাক খাচ্ছিলেন বমগার্টনার। শেষপর্যন্ত দীর্ঘদিনের বেইজ জাম্পিং এবং স্কাইডাইভিংয়ের অভিজ্ঞতাই তাকে বাঁচিয়ে দেয় মৃত্যুর হাত থেকে। নিয়ন্ত্রণ ফিরে পান নিজের ওপর। ফিরে আসেন ডেল্টা পজিশনে।
কিন্তু নাটকীয়তার শুরু আরো আগেই। মিশন শুরু হবার আগেই একদম শেষ মুহূর্তের ইকুইপমেন্ট চেকে ধরা পড়ে, নষ্ট হয়ে গেছে বমগার্টনারের স্পেস স্যুটের হিটারটি। ফলে বমগার্টনার শ্বাস ফেললেই ঘোলা হয়ে যাচ্ছিলো তার ভাইজরটি। ছোট ত্রুটি মনে হলেও, ওই নষ্ট হিটারটির জন্য তার মৃত্যু হতে পারতো।
তবুও আর পিছপা হতে রাজি ছিলেন না বমগার্টনার। ঘোলাটে দৃষ্টিসীমার কারণে আছড়ে পড়তে পারতেন পৃথিবীতে। পুরো দলের সঙ্গে আলোচনা করে মিশন চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
ফেলিক্সের প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন আরেক কিংবদন্তী মার্কিন এয়ারফোর্স কর্ণেল জো কিটেনগার। বিশ্বের উচ্চতম স্কাইডাইভিংয়ের রেকর্ডটির মালিক এতোদিন ছিলেন কিটেনগার। সেই রেকর্ডের পাঁচ দশক পর নতুন রেকর্ড গড়ে যেন গুরুর নাম রাখলেন শিষ্য ফেলিক্স।
শুরু থেকেই ফেলিক্সের সঙ্গে ছিলেন কিটেনগার। যখনই হতাশ হয়ে পড়েছেন বমগার্টনার, নিজের দক্ষতাকে প্রশ্ন করেছেন, তখনই উৎসাহ জুগিয়েছেন কিটেনগার। দিয়েছেন সাহস ও অনুপ্রেরণা। ফেলিক্স মাটিতে অবতরণ করার পর জ্যেষ্ঠ এই কিংবদন্তী বলেন, ‘ফেলিক্স খুবই সাহসিকতার সঙ্গে কাজটি করেছে। ওর সঙ্গে কাজ করতে পেরে আমি গর্বিত।’
২০০৫ সালে প্রথম এই স্কাইডাইভিংয়ের কথা মাথায় আসে বমগার্টনারের। এরপর অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করেন তিনি। ১৪ অক্টোবর নিউ মেক্সিকোর আকাশে বাতাসের চাপ ছিলো মাত্র ২ শতাংশ। বমগার্টনারকে মহাকাশে পৌঁছে দিতে নভোচারীদের স্পেস ক্যাপসুলের ডিজাইন অনুকরণ করে বানানো হয়েছিলো একটি বিশেষ ক্যাপসুল। হিলিয়াম বেলুন ক্যাপসুলটিকে উড়িয়ে নিয়ে যায় মাটি থেকে প্রায় ২৪ মাইল উপরে। স্পেস স্যুটটিও বানানো হয় নভোচারীদের স্পেস স্যুটের আদলে।
বমগার্টনারের এই ইতিহাস গড়া স্কাইডাইভিংয়ের বৈজ্ঞানিক গুরুত্বও কিন্তু কম নয়। দ্রুতগতিতে মহাকাশ থেকে পতন সম্পর্কে নানা তথ্য পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা, যা কাজে আসবে ভবিষ্যৎ স্পেস মিশনে। মিশনে বমগার্টনারকে নানাভাবে সহযোগিতা করেছিলো নাসাও।
বমগার্টনারের মিশনটি নিয়ে বিবিসি এবং ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক বানাচ্ছে একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম। নভেম্বর মাসে দেখানো হতে পারে ডকুমেন্টারিটি।