ভারতে নারীরা মাঝরাতে তাদের আনন্দ-ফূর্তির ছবি তুলে কেন তা শেয়ার করছে
ভারতে মেয়েরা রাতের বেলা তাদের বেড়ানো আর আনন্দ-ফূর্তির ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করছে একজন রাজনীতিক "মেয়েদের বেশি রাতে বেরন উচিত নয়" এমন মন্তব্য করার প্রতিবাদে।
ভারতের চন্ডীগড়ে ডিজে-র কাজ করেন বর্ণিকা কুণ্ডু। গত শুক্রবার রাতে তিনি যখন বাসায় ফিরছিলেন তখন তার গাড়িকে পেছন থেকে গাড়ি নিয়ে কয়েকজন ছেলে ধাওয়া করে বলে তিনি অভিযোগ করেন। ওই ছেলেদের মধ্যে একজন ছিলেন ভারতে ক্ষমতাসীন বিজেপির একজন প্রথম সারির রাজনীতিকের ছেলে, বিকাশ বারালা।
বিবিসির গীতা পাণ্ডে জানাচ্ছেন মি: বারালাকে বুধবার পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে এবং পুলিশ বলছে তার বিরুদ্ধে "উত্যক্ত করা, মদ খেয়ে গাড়ি চালানো এবং অপহরণের চেষ্টার" অভিযোগ আনা হয়েছে।
বর্ণিকার অভিযোগ তাকে "গাড়ি নিয়ে পেছু-ধাওয়া এবং প্রায় অপহরণের" চেষ্টা করা হয় এবং তাকে যে "ধর্ষণ ও হত্যা করে কোনো খানা-খন্দে ফেলে দেওয়া হয়নি" তার কারণ তিনি বিপদে বলে পুলিশের সাহায্য চাওয়ার পর পুলিশ দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে তাকে উদ্ধার করে।
মিস কুণ্ডু ফেসবুকে তার এই ঘটনা সম্পর্কে পোস্ট দেবার পর তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায় এবং মিস কুণ্ডুর এই ঘটনার জন্য হরিয়ানা রাজ্যের শীর্ষ বিজেপি রাজনীতিক রামবীর ভাট্টি মেয়েটির ওপরই দোষারোপ করেন।
"মেয়েদের মাঝরাতে বাইরে বেরন উচিত নয়," সিএনএন নিউজ এইট চ্যানেলকে একথা বলেন মি: ভাট্টি। "মেয়েটি এত রাতে গাড়ি চালাচ্ছিল কেন? দিনকাল ভাল না। আমাদের নিজেদের দেখাশোনা নিজেদেরই করতে হবে।"
মি: ভাট্টি এরপর টাইমস অফ ইন্ডিয়াকে বলেন "বাপ-মায়েদের উচিত তাদের সন্তানদের দেখা। সন্তানদের রাতে ঘুরে বেড়াতে দেওয়া তাদের উচিত নয়। বাচ্চাদের সময়ে ঘরে ফেরা উচিত। রাতের বেলা কেন তারা বাইরে ঘুরবে?"
ঘটনার শিকার যে মেয়ে তাকে "লজ্জা দিয়ে" রাজনীতিকের এই মন্তব্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এবং মেয়েরা রাতের বেলা তাদের ঘুরে বেড়ানোর ছবি পোস্ট করছে #AintNoCinderalla এই হ্যাশট্যাগে- অর্থাৎ আমি রূপকথার সেই সিন্ডারেলা নই যে রাত বারোটা বাজার আগেই আমাকে বাসায় ফিরতে হবে।
গীতা পাণ্ডে বলছেন এই প্রচারণার উদ্যোক্তা বিরোধী কংগ্রেস দলের সোসাল মিডিয়া সেলের প্রধান দিব্যা স্পন্দনা। তিনি দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের জনপ্রিয় চলচ্চিত্রাভিনেত্রী পর্দায় যার নাম রম্যা।
তিনি প্রশ্ন তোলেন মেয়েরা কেন মাঝরাতের পর বেরতে পারবে না? "মি: ভাট্টির কাছে আমার প্রশ্ন মেয়েদের উপর কারফিউ জারি করার তিনি কে? আমি জানতে চাই আমাদের দিকে তিনি কেন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছেন? এটা খুবই পশ্চাদপদ মনোভাব," বিবিসিকে বলেন মিজ স্পন্দনা।
দিব্যা স্পন্দনা সোমবার তার হোয়াটসআপ গ্রুপে কিছু মেয়েদের উদ্দেশ্যে বার্তা পাঠান: "একজন 'নেতা' যার যে কোন বিষয়ে কথা বলা সাজে না, তার মুখে এমন পশ্চাদপদ মন্তব্য তোমরা কতবার শুনেছো? আমার উত্তর হবে- প্রায়ই।"
"এখন তারা বলছে আমরা কখন বাসা থেকে বেরব অথবা বেরব না- এটা বন্ধ হওয়া দরকার," তিনি বলেন। এরপর তিনি টুইটারে তার রাতে বেরনর ছবি পোস্ট করেন এবং অন্যদেরও তা করার আহ্বান জানান।
তার এই আহ্বান মেয়েদের মধ্যে দ্রুত সাড়া ফেলে এবং এধরনের ঘটনায় সবসময় মেয়েদের উপর দোষ চাপানোর প্রতিবাদ জানাতে শত শত মেয়ে ফেসবুক, টুইটার ও ইনস্টাগ্রামে তাদের ছবি পোস্ট করতে শুরু করে।
প্রথম যে কয়জন মেয়ে 'মাঝরাতের সেলফি' পোস্ট করেন তাদের মধ্যে ছিলেন ভারতের সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জ্জীর মেয়ে শর্মিষ্ঠা মুখার্জ্জী। তিনি লেখেন : "আমি রাত বারোটায় বাড়ির বাইরে- তার মানে এই নয় যে আমাকে ধর্ষিতা, নির্যাতিতা বা ধাওয়ার শিকার হতে হবে। আমার সাতদিন ২৪ ঘন্টা সম্মান পাবার অধিকার আছে।"
আরো পড়ুন:
অনেকেই এরপর নানাধরনের প্রতিবাদী মন্তব্য পোস্ট করেন সামাজিক মাধ্যমে। যেমন নিচের বার্তায় পূজা লেখেন: "প্রিয় পশ্চাদপদ ভারত- আমার যা খুশি আমি তাই করব- রাতে অথবা দিনে। ভুলেও ভেবো না আমাকে থামানোর অধিকার তোমার আছে।"
সাংবাদিক পালক শর্মা তার যে ছবি পোস্ট করেন তাতে দেখা যায় তিনি পানীয়ে চুমুক দিচ্ছেন এবং ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে চোখ মারছেন । তিনি লেখেন -এখন মাঝরাত- আমি বাইরে। তার এই ছবি ও বার্তাকে ''দু:সাহসী'' মন্তব্য করে অনেকেই তাকে অভিনন্দন জানিয়েছে।
তবে বিবিসিকে পালক শর্মা বলেছেন, ''গত দুদিনে আমি প্রচুর হুমকিও পেয়েছি। লোকে আমাকে পতিতা-এধরনের মন্তব্যও করেছে।''
''ভাবুন- আমি একজন সাংবাদিক, আমি সরকার নিয়ন্ত্রিত মিডিয়াতে কাজ করি। তা সত্ত্বেও আমার টুইটের জন্য আমাকে হুমকি শুনতে হচ্ছে,'' তিনি বলেন।
''তবে আমি ভয় পাইনা,'' মিস শর্মা বলেন। ''এসব আমাদের দমিয়ে রাখতে পারবে না, আমরা এদের ভয়ে গুটিয়ে যাব না। আমরা সিন্ডারেলা নই - যে বারোটার আগেই আমাদের ঘরে ফিরে আসতে হবে।''
এই প্রচারণায় সুর মেলাচ্ছেন অনেক মহিলা। বিবিসির গীতা পান্ডে বলছেন অন্তত তাদের মন্তব্য পড়ে মনে হচ্ছে না তারা ভীত।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন