Translate

শুক্রবার, ৩০ মার্চ, ২০১২

পারমাণবিক দুর্ঘটনার সেকাল-একাল

  • পারমাণবিক দুর্ঘটনায় ফুকুশিমার ভয়াবহ চিত্র পারমাণবিক দুর্ঘটনায় ফুকুশিমার ভয়াবহ চিত্র
  • চলছে উদ্ধার তৎপরতা চলছে উদ্ধার তৎপরতা
1 2
১১ মার্চ ছিল জাপানের ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিস্ফোরণের প্রথম বার্ষিকী। ১৯৮৬ সালের চেরনোবিল দুর্ঘটনার পর ফুকুশিমা পারমাণবিক দুর্ঘটনা হলো সবচেয়ে ভয়াবহ। তবে সময়ের কারণেই দুটি দুর্ঘটনার মধ্যে ফারাক ছিল বিস্তর। এ দুটি দুর্ঘটনার পার্থক্য তুলে ধরেছেন পরমাণু বিজ্ঞানী জাকিয়া বেগম

প্রায় ৬০ বছরের পারমাণবিক চুল্লির ইতিহাসে বিশ্বে যে কয়েকটি পারমাণবিক দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে ১৯৮৬ সালের ২৬ মার্চ রাশিয়ার চেরনোবিলে এবং অন্যটি ২০১১ সালের ১১ মার্চ জাপানের ফুকুশিমায় সংঘটিত দুর্ঘটনা দুটিকে অন্যতম ভয়াবহ বলে চিহ্নিত করা হয়। এ দুটি দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে বেশ কিছু পার্থক্য আছে বলে বিশেষজ্ঞরা মত প্রকাশ করেছেন। পার্থক্যগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়:

 ১৯৭১ সালে স্থাপিত ফুকুশিমার চুল্লিটি ৪০ বছরের আয়ুষ্কাল শেষ করে বর্ধিত সময়ের জন্য পরিচালনার অনুমোদনপ্রাপ্ত ছিল। কিন্তু ১৯৭৭ সালে স্থাপিত চেরনোবিলের চুল্লিটি দুর্ঘটনার আগে মাত্র নয় বছর বিদ্যুৎ উৎপাদন করে।
 চেরনোবিলের চুল্লিতে প্রযুক্তিগত ত্রুটি ছিল। উপরন্তু, নিরাপত্তাসংক্রান্ত সতর্কতা অবলম্বন না করে গবেষণা পরিচালনার সময় ভুলের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু চুল্লির নকশায় উচ্চমাত্রার সুনামির সম্ভাবনা বিবেচনায় না রাখায় রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প-পরবর্তী সুনামি ফুকুশিমা দুর্ঘটনার কারণ।
 চেরনোবিলের ক্ষেত্রে দুর্ঘটনার সময় চুল্লি সক্রিয় থাকায় ফিশনবিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে ওঠে এবং মুহূর্তে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে বিস্ফোরিত পারমাণবিক বোমার চেয়ে ভয়াবহ ও মারাত্মক বিস্ফোরণ ঘটে। ফুকুশিমায় ভূমিকম্পের সঙ্গে সঙ্গে ফিশনবিক্রিয়া থেমে গিয়ে চুল্লিগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কেন্দ্রে কোনো রকম বিস্ফোরণ ঘটেনি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সুনামির আঘাতে শীতলীকরণ পদ্ধতি অকার্যকর হয়ে পড়ায় চুল্লির কেন্দ্র অতিরিক্ত মাত্রায় উত্তপ্ত হয়ে উঠে কোনোটি আংশিকভাবে এবং কোনোটির অধিকাংশই গলে যায়। ব্যবহূত জ্বালানির আধারগুলোর ঠান্ডাকরণ পদ্ধতিও অকার্যকর হয়ে পড়ে।
 ১ গিগাওয়াট শক্তিসম্পন্ন চেরনোবিলের চুল্লিটির কেন্দ্র ইদানীংকালের চুল্লিগুলোর চেয়ে প্রায় তিন গুণ বড় ছিল। এত বিরাট চুল্লি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ায় তা প্রচণ্ডভাবে বিস্ফোরিত হয়। ফুকুশিমারটি ৪ দশমিক ৭ গিগাওয়াট শক্তিসম্পন্ন।
 ‘হাইপ্রেশার ওয়াটার রিঅ্যাকটর টাইপ’ চেরনোবিলের চুল্লিতে রিঅ্যাকটর ভেসেল এবং কনটেইনমেন্ট বিল্ডিং ছিল না। ‘বয়েলিং ওয়াটার টাইপ’ ফুকুশিমার চুল্লিতে বর্তমানে ব্যবহূত অন্যান্য চুল্লির মতো জ্বালানিসংবলিত কেন্দ্র খুব পুরু স্টিলের তৈরি চাপযুক্ত আধারের মধ্যে (রিঅ্যাকটর প্রেসার ভেসেল) আর সম্পূর্ণ চুল্লিটি যেকোনো ধরনের তেজস্ক্রিয় পদার্থ আবদ্ধ রাখতে সক্ষম স্টিল ও কংক্রিটের তৈরি বিশেষ ধরনের কাঠামোর মধ্যে স্থাপিত ছিল।
 ফুকুশিমার চুল্লিটি ‘লাইট ওয়াটার’ মডারেটরবিশিষ্ট হওয়ায় এটির কেন্দ্রে দাহ্য গ্রাফাইটের উপস্থিতি ছিল না। চেরনোবিল দুর্ঘটনাটি ভয়াবহ হয়ে ওঠার অন্যতম একটি কারণ, ‘গ্রাফাইট মডারেটেড’ চুল্লিতে গ্রাফাইটের উপস্থিতি, যা এটিকে অত্যন্ত দাহ্য করে তোলে। বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ডভাবে আগুন ধরে যায়, যার কারণে তেজস্ক্রিয় মেঘ আকাশে বহু ওপরে বিস্তৃতি লাভ করে, যা প্রায় ১০ দিন পর্যন্ত জ্বলতে থাকে।
 ফুকুশিমার ছয়টি চুল্লির মধ্যে চারটি এবং ‘স্পেন্ট ফুয়েলে’র আধার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চেরনোবিলের চারটি চুল্লির মধ্যে মাত্র একটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
 ফুকুশিমার চুল্লিতে জ্বালানির পরিমাণ ছিল এক হাজার ৬০০ টন আর চেরনোবিলে ১৮০ টন।
 ফুকুশিমায় অত্যন্ত উচ্চ তাপমাত্রায় চুল্লির ভেতরের বাষ্প থেকে হাইড্রোজেন আলাদা হয়ে যায়, যা চুল্লির স্থাপনার ভেতরে জমা হয়ে বিস্ফোরণের সৃষ্টি করে। ফলে স্থাপনার ছাদের একটি অংশ বিধ্বস্ত হয়, তবে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ নির্গমনের ক্ষেত্রে এর কোনো ভূমিকা ছিল না। তা ছাড়া চুল্লির ভেতরে বাষ্পীয় চাপ কমিয়ে বিস্ফোরণ ঠেকানোর লক্ষ্যে অপারেটররাও ইচ্ছাকৃতভাবে বাষ্পীয় মেঘ বাতাসে বিমুক্ত করে দেয়। এই বাষ্পের মধ্যস্থ তেজস্ক্রিয় কণাগুলোর অর্ধায়ু মাত্র কয়েক সেকেন্ড হওয়ায় এগুলো বাতাসে মিশে যাওয়ার আগে বিকিরণমাত্রা মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর পর্যায়ের নিচে নেমে আসে। তা ছাড়া প্রশান্ত মহাসাগরের তীরবর্তী হওয়ায় এবং দুর্ঘটনার সময় বাতাস সাগরের দিকে ধাবিত হওয়ায় এ ক্ষেত্রে তেজস্ক্রিয় পদার্থগুলোর অধিকাংশ সাগরে গিয়ে পড়ে, যা সাগরের পানির সঙ্গে মিশে তরলকৃত হয়ে পড়ে।
 পরবর্তী সময়ে প্রচণ্ড উত্তাপে চুল্লি গলিত অবস্থায় চলে যাওয়ায় এবং স্থাপনার ভেতরের কিছুটা অংশে ফাটল দেখা দেওয়ায় এ ফাটল এবং সেই সঙ্গে উত্তপ্ত স্পেন্ট ফুয়েল দিয়ে তেজস্ক্রিয়তাযুক্ত পানি ও বাষ্প বের হতে থাকে, যা পরিবেশকে দূষণযুক্ত করে তোলে। তা ছাড়া শীতলীকরণের কাজে ব্যবহূত পানি সমুদ্রে ছেড়ে দেওয়ায়ও বেশ কিছু তেজস্ক্রিয় পদার্থ বাতাস ও পানিতে মিশে যায়।
 যদিও দুটি ক্ষেত্রেই দুর্ঘটনার মাত্রা পারমাণবিক দুর্ঘটনার স্কেলে ৭, তাই ফুকুশিমা দুর্ঘটনায় পরিবেশে ছড়িয়ে পড়া তেজস্ক্রিয় পদার্থের পরিমাণ চেরনোবিল দুর্ঘটনার মাত্র ১০ শতাংশ।
 ফুকুশিমায় তেজস্ক্রিয়ার কারণে কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। চেরনোবিলে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার ২০০ পিকোবেকারেল তেজস্ক্রিয়ার বিকিরণপাত হয় এবং তাৎক্ষণিকভাবে দুজন, পরবর্তী এক সপ্তাহের মধ্যে জরুরি উদ্ধারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের মধ্যে প্রায় ৫০ জন মারা যায়। প্রায় ছয় লাখ মানুষ অত্যন্ত উচ্চমাত্রার বিকিরণ দ্বারা সম্পাতিত হয়ে পড়ে। কাছের একটি বনাঞ্চল সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়, চারপাশে বিস্তীর্ণ এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নিজ দেশের গণ্ডি পেরিয়ে পাশের ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বিরাট এলাকাজুড়ে তেজস্ক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ায় এসব দেশের উদ্ভিদ ও প্রাণীকুল তেজস্ক্রিয় ঝুঁকির সম্মুখীন হয়।
 ফুকুশিমায় দুর্ঘটনাস্থল থেকে উত্তর-পশ্চিমে ৬০ কিলোমিটার এবং দক্ষিণ, দক্ষিণ-পশ্চিমে ৪০ কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকায় বিকিরণমাত্রা বার্ষিক গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে ঊর্ধ্বে এবং সর্বোচ্চ তেজস্ক্রিয়া ৩৭০ পিকোবেকারেল পরিলক্ষিত হয়। এ ক্ষেত্রে বিরাট এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ার সম্ভাবনা অনেকটাই কম।
 তৎকালীন সোভিয়েত সরকার প্রথম দিকে বাসিন্দাদের দুর্ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করা থেকে বিরত থাকে এবং দ্রুত পাশের এলাকার বাসিন্দাদের নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়। খাদ্য গ্রহণ সম্পর্কে কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ না করায় আয়োডিনযুক্ত তেজস্ক্রিয়যুক্ত দুধ গ্রহণের কারণে আক্রান্ত শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে প্রায় ছয় হাজার জন পরবর্তী সময়ে থাইরয়েড ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে কয়েকজন মারা যায়।
 ফুকুশিমায় ক্ষতিকর আয়োডিন নিঃসরণের পরিমাণ চেরনোবিলের চেয়ে প্রায় সাত গুণ কম। তা ছাড়া জাপান সরকার খুব দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা থেকে জনসাধারণকে সরিয়ে নেওয়ায় এবং সময়োপযোগী কিছু পদক্ষেপ নেওয়ায় তেজস্ক্রিয় সম্পাত থেকে অনেকেই রক্ষা পায়। ২০-৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকায় জন্মানো খাদ্যশস্য গ্রহণ করার ব্যাপারে সতর্ক এবং বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এলাকার পশুর দুধ ও দুগ্ধজাতদ্রব্য শিশুদের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়। এমনকি প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত টোকিও নগরের কলের পানি শিশুখাদ্যের জন্য সাময়িকভাবে উপযোগী নয় বলে সাবধানতা গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়। তা ছাড়া শিশুদের স্থায়ী আয়োডিন খাইয়ে তেজস্ক্রিয় আয়োডিন থাইরয়েডে জমা হওয়ার আশঙ্কা কমিয়ে আনায় থাইরয়েড ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কাও কমানো হয়েছে।
 চেরনোবিলে কৃষি এলাকাজুড়ে ৩০ বছর অর্ধায়ুবিশিষ্ট সিজিয়াম-১৩৭ এবং ২৮ বছর অর্ধায়ুবিশিষ্ট স্ট্রনশিয়াম-৯০ ছড়িয়ে পড়ে। ফুকুশিমায়ও প্রায় ২০০ মাইল এলাকাজুড়ে সিজিয়াম-১৩৭ ছড়িয়ে পড়ে।
 চেরনোবিলে দুর্ঘটনাকবলিত এলাকা থেকে প্রাথমিকভাবে প্রায় এক লাখ ১৫ হাজার মানুষ সরিয়ে নিয়ে পুনর্বাসন করা হয় এবং পরবর্তী সময়ে বেলারুশ, রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে প্রায় দুই লাখ ২০ হাজার মানুষ সরিয়ে নেওয়া হয়। ফুকুশিমায় দুর্ঘটনাকবলিত স্থাপনা থেকে প্রায় এক লাখ ১০ হাজার বাসিন্দাকে অন্যত্র স্থানান্তরিত করা হয়।
 ফুকুশিমার ক্ষেত্রে গণমাধ্যমগুলো বহু তথ্য সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে, যা চেরনোবিলের সময় সম্ভব ছিল না। তা ছাড়া ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে যোগাযোগ সহজতর হওয়ায় নানাবিধ পরামর্শ ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয়েছে।
লেখক: পরমাণু বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগ, ইউআইটিএস।a

কোন মন্তব্য নেই:

FSS blog

FSS TSTL Photo Gallery

FSS TSTL Photo Gallery
Pictures

I like it

  • Bangla Song
  • Love
  • Move

what is love?

এই ব্লগটি সন্ধান করুন

লেবেল

লেবেল

ভূমি (1) sex (6)

Wikipedia

সার্চ ফলাফল