বৃহস্পতিবার, ১৫ মার্চ, ২০১২

ইউনিসেফের বার্ষিক প্রতিবেদন বস্তির শিশুদের বঞ্চনা সবচেয়ে বেশি

ইউনিসেফ বলছে, বাংলাদেশে শহরের বস্তি এলাকায় শিশুমৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। শহরে হাতের কাছে হাসপাতাল ও জরুরি সেবা থাকলেও দরিদ্র ও বস্তির মানুষ সেসব সেবা গ্রহণ করতে পারছে না। বস্তির শিশুদের পুষ্টি-পরিস্থিতি গ্রামের দরিদ্র পরিবারের শিশুদের চেয়েও খারাপ।
গতকাল বুধবার জাতীয় প্রেসক্লাবে জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) ‘বিশ্ব শিশু পরিস্থিতি ২০১২’ প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এ তথ্য দেয় ইউনিসেফ। ইউনিসেফের এ বছরের বার্ষিক প্রতিবেদনের প্রতিপাদ্য ‘নগরজীবনে শিশু’।
অনুষ্ঠানে ইউনিসেফের পক্ষ থেকে এ দেশের শহর ও নগরের বস্তির শিশুদের বঞ্চনা ও বিপন্নতার চিত্র তুলে ধরা হয়। তাতে বলা হয়, প্রতি হাজার জীবিত জন্মে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর হার শহরে (অবস্তি এলাকা) ৫৫, গ্রামে ৬৬ এবং শহরের বস্তিতে ৯৫। গ্রামের ১৯ শতাংশ নবজাতক জন্মের সময় দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর সহায়তা পায়, বস্তিতে পায় ১৫ শতাংশ। শহরে (অবস্তি এলাকা) ও গ্রামে প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার যথাক্রমে ২৬ ও ২২ শতাংশ। বস্তিতে এই হার ১৩ শতাংশ। শহর ও গ্রামে ৮০ শতাংশ শিশু পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পৌঁছায়, বস্তিতে পৌঁছায় ৪৮ শতাংশ। ঝরে পড়ার হার শহরে ও গ্রামে ১ শতাংশ, বস্তিতে ৮ শতাংশ।
প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ উপস্থাপনের সময় ইউনিসেফের যোগাযোগ ব্যবস্থাপক আরিফা এস শারমীন বলেন, শহর ও নগরের শিশুদের ব্যাপারে সমন্বিত তথ্য নেই। বস্তির শিশুদের তথ্য পাওয়া কঠিন। এর অন্যতম কারণ, বস্তিতে জন্মনিবন্ধনের হার কম এবং ভূমির মালিকানা না থাকা।
‘বিশ্ব শিশু পরিস্থিতি ২০১২’ প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের বস্তির শিশুরা মোটা দাগে পাঁচ ধরনের বঞ্চনার শিকার। এগুলো হচ্ছে: স্বাস্থ্য, বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ ও উন্নত পয়োব্যবস্থা, বাসস্থানের নিরাপত্তা, শিক্ষা ও বিনোদন।
প্রতিবেদনে ৬০টির বেশি দেশের হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এইচআইভি ও এইডসে আক্রান্ত দেশগুলোয় সংক্রমণের হার কমে এলেও বাংলাদেশসহ সাতটি দেশে আক্রান্তের হার ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। শহরে এইচআইভির প্রকোপ বেশি।
ইউনিসেফ বলছে, রাজধানী ঢাকায় প্রত্যেক বাবা-মা প্রতিটি শিশুর পড়াশোনার জন্য মোট আয়ের ১০ শতাংশ ব্যয় করে। কিন্তু দরিদ্র পরিবারে এই ব্যয় ২০ শতাংশ। শহরাঞ্চলে ৫৩ ও গ্রামাঞ্চলে ৪৮ শতাংশ শিশু মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে; বস্তিতে করছে ১৮ শতাংশ।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ফকিরেরপুল বস্তির শিশু মৌসুমী আক্তার বলে, তাদের বস্তিতে ৫০-৬০ জন মানুষের জন্য মাত্র দুটি শৌচাগার ও দুটি চুলা। বড়দের ভিড়ে তারা ঠিকমতো শৌচাগার ব্যবহার করতে পারে না। বস্তির কিছু যুবক শিশুদের মাদক কেনাবেচায় বাধ্য করে। মেয়েরা বাল্যবিবাহের শিকার।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বস্তির জনসংখ্যা ২০১০ সালে ছিল ৭০ লাখ, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫ শতাংশ। বিশ্বের ২১টি প্রথম শ্রেণীর মেগাসিটির মধ্যে ঢাকার অবস্থান নবম। প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বস্তিবাসী শিশুর সংখ্যা নেই।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী গ্রামাঞ্চলের (৭৮ শতাংশ) চেয়ে শহরাঞ্চলের (৯৬ শতাংশ) মানুষ উন্নত সুপেয় পানির সুবিধা ভোগ করে। কিন্তু বস্তি এলাকায় ব্যাপক ঘনবসতির সঙ্গে নিরাপদ খাওয়ার পানি ও ন্যূনতম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য পর্যাপ্ত পানির সরবরাহ না থাকায় পুরো পরিবেশই দূষিত হয়ে পড়ছে। নিম্নমানের সেবার জন্যও বস্তিবাসীকে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয়।
বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি প্যাসকেল ভিলেনোভ বলেন, ‘নীতিনির্ধারকদের কাছে বস্তিতে এবং সুবিধাবঞ্চিত অবস্থায় থাকা শিশুরা প্রায়ই অদৃশ্য থাকে, পরিসংখ্যানের গড় অনুপাতের ভেতর হারিয়ে যায়।’
প্রতিবেদন সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক আবুল বারকাত বলেন, প্রতিবেদনটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক গড় হিসাবের বাইরে এসে বস্তির সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের তথ্য দিয়েছে ইউনিসেফ। তিনি বলেন, বস্তির শিশুরা বিপন্ন, বঞ্চিত ও বিচ্ছিন্ন।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সচিব ভূঁইয়া শফিকুল ইসলাম।

কোন মন্তব্য নেই: